শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, উপাচার্যের উত্তর

বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার শেষ পর্যায়ে থিসিস ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে গম্ভীর অধ্যাপকদের কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর সামলাতে হয় শিক্ষার্থীকে; শুক্রবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সামনে তার চেয়েও অসহায় এক পরিস্থিতিতে নিজেকে আবিষ্কার করলেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Oct 2019, 07:10 PM
Updated : 12 Oct 2019, 06:42 AM

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাঁচ দিন ধরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে গেলেন তাদের শিক্ষকের দিকে। অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে আড়াই ঘণ্টা ধরে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হল অত্যন্ত ধৈর্যে্যর সঙ্গে। 

বুয়েট অডিটোরিয়ামের মঞ্চে বসা উপাচার্য এবং তার নয় সহকর্মীর পেছনে ঝুলছিল একটি ব্যানার। সেখানে বড় হরফে লেখা ছিল- ‘বিচার চাই’।

বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার সবচেয়ে পুরনো এ শিক্ষায়তনে আর কোনো উপাচার্যকে হলভর্তি শিক্ষার্থীর সামনে এমন কঠিন পরীক্ষায় সম্ভবত পড়তে হয়নি।

দশ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা বুয়েটে তালা দেওয়ার ঘোষণা দিলে শুক্রবার এই বৈঠকে বসতে বাধ্য হন অধ্যাপক সাইফুল। শিক্ষার্থীদের শর্ত অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও এ সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ পান।  

বিকাল সাড়ে ৫টায় কানায় কানায় পূর্ণ অডিটোরিয়ামে বৈঠকে বক্তব্যের শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নেন উপাচার্য।

আবরার খুন হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “আমার ঘাটতি ছিল। পিতৃতুল্য হিসেবে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।”

বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে গত রোববার রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘোষণা দেন উপাচার্য। সেই সঙ্গে শিক্ষা্র্থীদের অন্যান্য দাবি পূরণেরও প্রতিশ্রুতি দেন।

রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া তুলে ধরে অধ্যাপক সাইফুল বলেন, “আমরা শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, ক্ষমতাসীন যে ছাত্র সংগঠন আছে, সেটির কমিটি বিলুপ্ত করতে বলবেন বলে জানিয়েছেন তারা। এটার ফল খুব কম সময়ের মধ্যে তোমরা জানতে পারবে।”

কিন্তু এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় উপাচার্যকে।

ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাবে না, এমন নিশ্চয়তা কীভাবে দিচ্ছেন- তা জানতে চান এক শিক্ষার্থী।

জবাবে উপাচার্য বলেন, “তাদের পদ-পদবী যদি নাই থাকে, তাহলে পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগ নাই। সেটা তোমরা দেখতে পাবে।”

ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মধ্যে ২০০২ সালে সাবেকুন নাহার সনি নিহতের পরও বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর আবার চালু হয়। সে প্রসঙ্গ টেনে এক শিক্ষার্থী উপাচার্যের কাছে জানতে চান, এবার কতদিন নিষিদ্ধ থাকবে?

জবাবে উপাচার্য বলেন, “সেটা কতদিন থাকবে, তুমিও বলতে পারো না, আমিও বলতে পারব না। তবে বুয়েটে সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখছি। শিক্ষকদের রাজনীতিও ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ থাকবে।”

এ বিষয়ে আরেক প্রশ্নে সভামঞ্চে থাকা ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতাও আমাদের এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে। আমরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিষয়ে আশ্বাস পেয়েছি। অন্যরাও যাতে আমাদের এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন, আমরা সেটাই চাইব।”

অবৈধভাবে হলে থাকা সাবেক শিক্ষার্থী এবং রুম দখল করে রাখা ছাত্রলীগ নেতাদের বিষয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চান এক শিক্ষার্থী।

 

জবাবে দিতে গিয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক জানান, বুয়েটের হলে প্রায় ৫০ শতাংশ সাবেক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে আছে। অবৈধভাবে যারা হলে থাকে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।

কবে নাগাদ উচ্ছেদ করা হবে- তা এক শিক্ষার্থী জানতে চাইলে অধ্যাপক মিজান বলেন, “রেইড দিয়ে তাদের বের করতে হবে। পুলিশও লাগবে। পুলিশ এখন আবরারের মামলা নিয়ে কাজ করছে। আমরা ক্রমান্বয়ে অভিযান চালাতে থাকব।”

তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ওই অভিযানের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করেন এক শিক্ষার্থী।  উত্তরে ছাত্র কল্যাণ পরিচালক বলেন, “আমরা প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট আর কয়েকজন শিক্ষক মিলেও অভিযান শুরু করতে পারি।”

শিক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে সাময়িকভাবে বহিষ্কৃতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার ওপর জোর দেন।

উপাচার্য সাইফুল ইসলাম তখন বলেন, তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া কাউকে বহিষ্কার করলে সেটা কোর্টে গিয়ে উল্টে যায়। সে কারণে বুয়েটের তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বুয়েটের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কবে নাগাদ পাওয়া যাবে- তা উপাচার্যের কাছে জানতে চান এক শিক্ষার্থী।

উত্তরে তিনি বলেন, তারা কাজ শুরু করেছে। শেরেবাংলা হলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে। আরও ৮-১০ দিন সময় লাগতে পারে।

উপাচার্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। ১৪ তারিখে অনুষ্ঠেয় ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন।

এক শিক্ষার্থী তখন বলেন, “এখনো হলগুলোতে আছে অবৈধভাবে অবস্থান করা অনেকে। এমন সন্ত্রাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আনবেন কীভাবে?”

উপাচার্য জবাবে বলেন, ”আমরা সবাই মিলে চাইলে পরিবেশ ফিরে আসবে। ভর্তি পরীক্ষাটা আগে হোক, তারপর সব দেখা যাবে। সারাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিশ্চয়তাটুকু আমাদের দিতে হবে।”

শিক্ষার্থীদের বহু প্রশ্নের এক পর্যায়ে উপাচার্য বলেন, “তোমরা সহজ হও, ভর্তি পরীক্ষাটা নিতে দাও। যে কাজগুলো করার আছে, সেগুলো করতে দাও।”

এরকম একের পর এক প্রশ্নের মধ্যে কোনো ধরনের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় প্রায় তিন ঘণ্টার ওই বৈঠক।