ডাকসু সদস্য সৈকত এখন ‘গণরুমের নেতা’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের ‘গণরুম’ নামের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাকসু নির্বাচনে ভোট চেয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকত। কিন্তু ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছয় মাসেও কোনো সমাধান দিতে না পারার আক্ষেপ থেকে সিট ছেড়ে তিনি নাম লিখিয়েছেন গণরুমের খাতায়।

দীপক রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2019, 06:37 AM
Updated : 12 Sept 2019, 12:33 PM

কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক ছাত্র সৈকত থাকতেন ৩২০ নম্বর কক্ষে। গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে সেখান থেকে তিনি গিয়ে ওঠেন ২০৮ নম্বর কক্ষে। এই হলের অনেকগুলো গণরুমের মধ্যে এটি একটি।  

ওই কক্ষের মেঝেতে টানা বিছানা পেতে গাদাগাদি করে থাকেন প্রথম বর্ষের জনা পঁচিশেক শিক্ষার্থী। নাট্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর হাসান সৈকত এখন রাতে তাদের সাথেই ঘুমান। 

গত ৪ সেপ্টেম্বর ওই গণরুমে কেক কেটে সৈকতের জন্মদিন পালন করা হয়। ওই কক্ষের ‘ছোট ভাইদের’ কাছে সৈকত হয়ে উঠেছেন ‘গণরুমের নেতা’।

কবি জসীমউদ্দীন হলের ১২০টি কক্ষের ধারণক্ষমতা চারশর কম; কিন্তু শিক্ষার্থী আছে হাজারের বেশি। আবাসন সঙ্কটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলের চিত্রই এরকম। ১৭টি হল মিলিয়ে গণরুমের সংখ্যা শতাধিক। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় এসব গণরুমে। কারা এসব কক্ষে থাকবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে।   

সৈকত ছাত্রলীগের গত কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। গত ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকেই সদস্য পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাকেও প্রথম দিকে ২০৮ নম্বর কক্ষের ওই গণরুমে থাকতে হয়েছিল।

মঙ্গলবার রাতে কথা হয় ওই কক্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। গণরুমের জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা তারা তুলে ধরেন। সৈকতের চেষ্টায় এসব সমস্যার সমাধান হবে- এমন আশা করার কথাও কেউ কেউ বলেন।

আবার কয়েকজন বলেছেন, সৈকত এসে গণরুমে থাকায় ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ কথা শুনতে হচ্ছে তাদের।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র খোরশেদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু ভর্তি হয়ে যখন হলের এই গণরুমে থাকতে হয়, তখন মনে হয়, দুঃস্বপ্নের মধ্যে এসে পড়েছি। ছাড়পোকার যন্ত্রণায় ঘুমও হয় না ঠিকমত।’’

তবে ‘বড় ভাই’ সৈকত গণরুমে এসে ওঠায় আশা দেখতে পাচ্ছেন খোরশেদ।

“আমাদের এ সমস্যাটা নিয়ে আগে তেমন কথা হত না। সৈকত ভাই আমাদের সাথে থাকার ফলে এখন অনেকে মাথা ঘামাচ্ছে। আমরা আশা করছি সৈকত ভাইয়ের মাধ্যমেই এর একটা সমাধান হবে।”

সৈকত বলছেন, গণরুম সমস্যার সমাধানে প্রশাসনের ‘দৃশ্যমান’ কোনো পদক্ষেপ না দেখা পর্যন্ত তিনি ওই কক্ষেই থাকবেন।

এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর কিছু প্রস্তাবসহ একটি স্মারকলিপি তিনি দিয়ে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে।

ডাকসুর এই সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীই মেধাবী। কিন্তু এই গণরুম তাদের মেধার বিকাশের পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।”

ডাকসুর সভায় গণরুমের সমস্যা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানিয়ে সৈকত বলেন, “অন্য ছাত্র প্রতিনিধিরাও গণরুমের বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। তারা আরেকটু বড় করে ভাবুক, এটাই আমি চাচ্ছি, যাতে তাদের ভাবনাটা আরেকটু সামনে আসে, যাদে সবাই মিলে চাপ দেওয়া যায়, প্রশাসন দ্রুত উদ্যোগী হয়।”

এই ছাত্রলীগ নেতা জানান, উপাচার্যের কাছে দেওয়া স্মারকলিপির অনুলিপি তিনি শিক্ষক সমিতির সভাপতি, প্রক্টরের কার্যালয়, সব হলের প্রভোস্টের কাছে দিয়েছেন, ডাকসুর সব নেতাদেরও দিয়েছেন।

“এরপরেও তেমন একটা সাড়া আমি পাইনি। তবে ভিসি স্যার আমাকে বলেছেন যে আমার প্রস্তাবগুলো তিনি প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাবেন।’’

জোরালো সাড়া না পাওয়ায় দমে যাননি জানিয়ে সৈকত বলেন, “গণরুমে যেহেতু আমি ঢুকেছি, গণরুমের সমস্যার সমাধান করেই আমি এখান থেকে বের হব। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি গণরুমেই থাকব।”

সৈকতের এই পদক্ষেপকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। অন্যরাতও সৈকতের মত উদ্যোগী হবেন বলে আশা করছেন তিনি। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হলে থাকতে গেলে শিক্ষার্থীদের যে রাজনৈতিক দাসত্বের শিকার হতে হয়, তা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের অন্যতম মৌলিক চাওয়া। তারা চায়, মেধার ভিত্তিতে হলে সিট পাওয়ার ব্যবস্থাটুকু অন্তত প্রশাসন করবে।

“আমি ভিপি হিসেবে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও ছাত্রলীগের বাধার মুখে কাজ করতে পারিনি। আমি এ বিষয়ে ভিসি স্যারকে বলে এবং হল প্রভোস্টদের চিঠি দিয়েও কার্যকর কিছু করতে পারিনি। সৈকত ডাকসুর একজন সদস্য হিসেবে নৈতিক জায়গা থেকে গণরুমে যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীরাও সোচ্চার হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে ।”

নুর বলেন, সৈকতের মত ডাকসুর অন্যান্য পদধারীদেরও ‘নৈতিক বোধোদয়’ ঘটবে- এই প্রত্যাশাই তিনি করছেন।

সৈকতের অভিনব চেষ্টা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জসীমউদদীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গণরুমের সমস্যা যতটা না প্রশাসনিক তারচেয়ে বেশি ‘রাজনৈতিক’।

“ডাকসু এবং হল সংসদকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যদি গণরুমগুলোকে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার মধ্যে রাখতে হল প্রশাসনকে সাহায্য করে, তাহলে হল প্রশাসন কিছু একটা করতে পারবে। আর না হলে হল প্রশাসনের করার কিছু থাকবে না।”