সেশনজটের চক্করে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা

নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার শেষ না হওয়ায় নিজেদের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় রয়েছেন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2019, 01:51 PM
Updated : 17 April 2019, 01:51 PM

‘সেশনজটের’ চক্কর তৈরি হওয়ার পেছনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের অপর্যাপ্ততা আর শিক্ষকদের গাফিলতিকে দায়ী করলেও শিক্ষকরা তা মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, এক বছরেই মধ্যেই কমে আসবে সমস্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগ নাট্যকলার ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। কিন্তু তিন সেমিস্টার পিছিয়ে তারা এখন অনার্স অষ্টম সেমিস্টারে রয়েছেন।

২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ ২০১৮ সালে অনার্স শেষ করে এখন মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও শিক্ষার্থীরা আটকে আছেন অনার্স ষষ্ঠ সেমিস্টারে।

শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে সিঁড়িতে ক্লাস করতে হয় চারুকলার শিক্ষার্থীদের

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে এখন সপ্তম সেমিস্টারের ক্লাস চলার কথা থাকলেও পঞ্চম সেমিস্টারই শেষ করতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। আর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম সেমিস্টারের পরিবর্তে আটকে আছেন চতুর্থ সেমিস্টারে।

শিক্ষার্থীরা জানান, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস না হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক ও ক্লাসরুমের সঙ্কট রয়েছে।

এ বিভাগের জন্য শ্রেণিকক্ষ রয়েছে মোটে তিনটি, যার একটি আবার ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের । এছাড়া নাটকের মহড়ার কক্ষ থাকলেও সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় অন্যান্য বিভাগে গিয়ে মহড়া করতে হয় শিক্ষার্থীদের।

বিভাগটিতে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন আটজন, যাদের পাঁচজন নিয়োগ পেয়েছেন গত বছরের শেষ দিকে। ফলে শুরু থেকেই সঙ্কটে জর্জরিত বিভাগটি।

আরেক নতুন বিভাগ চারুকলায় এসব সঙ্কট তো রয়েছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে উপকরণের অপ্রতুলতা।

চারুকলার ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ২০১৮ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তারা বর্তমানে অনার্স সপ্তম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও তারা এখন রয়েছেন সপ্তম সেমিস্টারে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ষষ্ঠ সেমিস্টারে।

শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে সিঁড়িতে ক্লাস করতে হয় চারুকলার শিক্ষার্থীদের

বিভাগটিতে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৪টি। এছাড়া নতুন একাডেমিক ভবনের নির্মাণাধীন ২টি কক্ষ ব্যবহার করছে বিভাগটি। আর শিক্ষক সংখ্যা ছয়জন।

বিভাগটি ঘুরে দেখা যায় শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে বারান্দা, সিঁড়ি ও ছাদে বসে ক্লাস চালিয়ে নিতে হচ্ছে চারুকলার শিক্ষার্থীদের।

বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মিফতাহ আল ইহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্লাসরুমের তীব্র সংকট আমাদের। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের তিনটি ব্যাচে নয়টি ডিসিপ্লিন রয়েছে। একেকটি ডিসিপ্লিনের জন্য একটি করে রুম দরকার। আর অন্যান্য ক্লাসের জন্য তো আরও ক্লাসরুম দরকার। সেখানে ৬ ব্যাচের জন্য রুমই আছে মাত্র চারটি।

আরেক শিক্ষার্থী জানালেন, প্রতি সেমিস্টারে বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করতেই আট-দশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়ার কথা।

সংগীত বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে পরিবর্তে অনার্স অষ্টম সেমিস্টার ও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম সেমিস্টারের পরিবর্তে ষষ্ঠ সেমিস্টারে রয়েছেন।

শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে সিঁড়িতে ক্লাস করতে হয় চারুকলার শিক্ষার্থীদের

এ বিভাগের নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ একটি। দুপুর ১২টা পর‌্যন্ত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আরেকটি কক্ষ ব্যবহার করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। মাঝে মাঝে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের কক্ষেও ক্লাস করতে হয় শিক্ষার্থীদের।  তিনজন খণ্ডকালীনসহ এই বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন নয়জন।

ইংরেজি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স ২০১৮ সালে শেষ করার কথা থাকলেও সম্প্রতি তারা ক্লাস শুরু করেছেন। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ ২০১৮ সালে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও তারা রয়েছে অনার্স সপ্তম সেমিস্টারে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ষষ্ঠ সেমিস্টারে।

বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, “শিক্ষকদের গাফিলতির জন্য সেশনজট হচ্ছে। ক্লাসে এসে সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ) শিক্ষকদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে ক্লাসের সময় নির্ধারণ করেন। শিক্ষক বিভাগে থাকলে ক্লাস হয়, না হলে হয় না।”

শিক্ষকরা সান্ধ্যকালীন কোর্সে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ করেন এই শিক্ষার্থী।

“এমনও হয়, আমাদের নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে সে ক্লাসগুলো ইভনিংয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে নেওয়ার চেষ্টা করেন।”

আরও যেসব বিভাগে সেশনজট  

গণিত বিভাগে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন চলছে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে অনার্স অনার্স সেমিস্টারে।

আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ অনার্স সপ্তম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে), ইসলামিক স্টাডিজের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার ও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ অনার্স সপ্তম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও অনার্স অষ্টম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে রয়েছে।

শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে সিঁড়িতে ক্লাস করতে হয় চারুকলার শিক্ষার্থীদের

রসায়নের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স ২০১৮ সালে শেষ করার কথা থাকলেও এখন রয়েছে প্রথম সেমিস্টারে, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও এখন অনার্স অষ্টম সেমিস্টারের ক্লাস চলছে।

পরিসংখ্যান ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ২০১৮ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস করছেন। পরিসংখ্যানের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের পরিবর্তে আটকে আছেন অনার্স অষ্টম সেমিস্টারে।

নৃবিজ্ঞানের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও তারা রয়েছেন অনার্স অষ্টম সেমিস্টারে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ অনার্স সপ্তম সেমিস্টারে থাকার কথা থাকলেও ৪ মাস পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি ষষ্ঠ সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছেন।

এছাড়া ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বেশ কয়েকটি ব্যাচ ৮ থেকে ১০ মাস, মনোবিজ্ঞান বিভাগে ব্যাচভেদে রয়েছে প্রায় ১০ মাসের সেশনজট।

ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, “ক্লাসরুমের সঙ্কটে আমরা সময় মতো ক্লাস করতে পারি না। স্যাররাও নিয়মিত ক্লাস নিতে চান না।

“পরীক্ষার মাঝখানে চার-পাঁচবার রুটিন বদলায়, সেজন্য পরীক্ষা শেষ হতেই অনেক সময় চলে যায়। এভাবে চললে চাকরির প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।”

শিক্ষকদের ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ তুলে ধরে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, “দেখা যায় ৯টায় ক্লাস হবে, আমরা সারাদিন বসে আছি; সে ক্লাস আর হচ্ছে না। এভাবে আমরা কোনো কাজ করতে পারি না।”

শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিলে জট থাকত না বলে মনে করছেন এই শিক্ষার্থী। 

সেশনজটের কথা স্বীকার করলেও তা কমিয়ে আনার কথা বলছেন বিভাগগুলোর প্রধানরা।

নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন খান বলেন, “আমরা জানুয়ারি থেকে সব সেমিস্টারের ক্লাস নিয়মিত নিচ্ছি। এখন আর কোনো ব্যাচের সেশনজট থাকবে না।”

ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, “এক বছরের মধ্যে সেশনজট কমানোর চেষ্টা করব। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। এসব কারণে আমরা সেশনজটে পড়েছি।”

তবে সান্ধ্যকালীন কোর্সের কারণে এই সেশনজন হচ্ছে না বলে দাবি করেন এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, “ইভনিং প্রোগ্রামের কারণে আমাদের নিয়মিত কাজ আরও ত্বরান্বিত হয়। ইভনিংয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি, এ ধারণাটা ভুল।”

সেশনজটের কারণ হিসেবে শিক্ষক সঙ্কটকে তুলে ধরলেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মল্লিক আকরাম হোসেন।  

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় খাতা দেখতে সময় লাগে। তিনজন পরীক্ষক একটা খাতা দেখেন, খাতা বাইরে পাঠাতে হয়। এসব কারণে ফলাফল প্রকাশেই অনেক সময় চলে যায়।”

সেশনজট কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান।

তিনি বলেন, “সেশনজট কমিয়ে আনার জন্য আমরা সব বিভাগে চিঠি দিয়েছি। জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু করে জুনের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে সেমিস্টার শেষ করার নির্দেশ দিয়েছি।”

নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারলে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

তবে বিভিন্ন সঙ্কটের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে রেজিস্ট্রার বলেন, “আমি মনে করি না কোনো কিছুর সঙ্কট আছে। শ্রেণিকক্ষের কোনো সঙ্কট নেই। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ক্লাস-টাইম। এ সময়ের মধ্যে ক্লাস নিয়ে শেষ করতে পারে।”