কোথাও গলদ আছে, ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে বললেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী

বাংলাদেশে স্কুলে ইংরেজি পড়ানো হচ্ছে প্রথম শ্রেণি থেকে; কিন্তু স্নাতক পেরিয়ে আসা তরুণদের চাকরি দিতে গিয়ে এ ভাষায় যোগাযোগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে- এমন প্রার্থী খুঁজে পেতে সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে চাকরিদাতাদের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2018, 03:51 PM
Updated : 9 Nov 2018, 06:30 PM

বিশ্ববিদ্যালয় যে ইংরেজি শেখাচ্ছে, আর চাকরিক্ষেত্রে যেমনটা প্রয়োজন- এই দুই ক্ষেত্রে থেকে যাচ্ছে বিস্তর ফারাক। দেশে ইংরেজি শিক্ষার এই দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বক্তাদের কথায়। 

পেশার ধরন অনুযায়ী প্রায়োগিক ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শুক্রবার দেশে প্রথমবারের মত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) সেন্টার ফর ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ এবং বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেটসংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

একটি ২৪ ঘণ্টার বার্তাকক্ষে কাজ করার জন্য ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে এমন কর্মী খুঁজে পেতে কতটা সমস্যা পোহাতে হয়, সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

তিনি বলেন, দুটি ভাষায় সংবাদ প্রকাশের জন্য এমন সম্পাদক ও প্রতিবেদক প্রয়োজন, যাদের ইংরেজি ভাষার ওপর ভালো দখল আছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এমন কর্মী চায়, যারা দুটো ভাষাতেই দক্ষ।

“কিন্তু তেমন কর্মী খুঁজে পাওয়া সবসময়ই কঠিন। কোথাও একটি গলদ আছে।”

বিভিন্ন দেশের তাত্ত্বিক, পেশাজীবী, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, এনজিওকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও করপোরেটের অংশীজনরা অংশ নেন এ সম্মেলনে

খালিদী বলেন, একই ধরনের সমস্যায় পড়ার কথা তিনি তার উদ্যোক্তা বন্ধুদের কাছেও শুনেছেন। যারা কল সেন্টার পরিচালনা করেন, অন্য দেশের সঙ্গে যাদের প্রতিযোগিতা করতে হয়, তাদেরও যথাযথ ইংরেজি জানা লোক না পেয়ে সমস্যা পোহাতে হয়।

“আমাদের পর্যটন ও হসপিটালিটি সেবা খাত দ্রুত বড় হচ্ছে। সেখানেও একই সমস্যার কথা আমরা শুনতে পাই। আমি এরকম অনেক খাতের কথা বলতে পারি। মূল বিষয়টি হল, কোথাও একটি গলদ রয়েছে যেটা আমাদের সংশোধন করা দরকার। আর এ কারণেই আমরা আজ এই সম্মেলনে।”

 

ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে প্রয়োগিক জ্ঞানের এই পার্থক্য কীভাবে ঘোচানো যায়, সে বিষয়ে দিনব্যাপী এই সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে আলোচনা করেন বিভিন্ন দেশের তাত্ত্বিক, পেশাজীবী, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, এনজিওকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও করপোরেটের অংশীজনরা।

 ‘ইংলিশ ফর স্পেসিফিক পারপাজেস: কুড উই বি মোর স্পেসিফিক’ শীর্ষক এই সম্মেলনের উদ্বোধন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ইংরেজি ভাষা শেখার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ (১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনশক্তি যখন মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি) বাংলাদেশের জন্য যে সুযোগ নিয়ে এসেছে, ইংরেজি ভাষা ঠিকমত জানা না থাকলে তা কাজে লাগানো কঠিন হবে বলে মত দেন তিনি।

উন্নয়নের পথ ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেড়েছে কাজের সুযোগ, কিন্তু তা কাজে লাগাতে ইংরেজি ভাষায় দখল থাকা চাই: পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী

কূটনৈতিক পেশা থেকে রাজনীতিতে আসা মাহমুদ আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য দেশের তরুণদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পরিসরে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য ‘প্রয়োজনভিত্তিক’ ইংরেজি জানা তরুণদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

বৈচিত্র্যময় চাকরির বাজারের জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর যে ধরনের দখল দরকার, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখা ইংরেজির বিপুল ব্যবধানের বিষয়টিতেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এই দূরত্ব ঘোচাতে চিকিৎসা, প্রকৌশল, কূটনীতিসহ আলাদা আলাদা পেশার জন্য উপযোগী করে ইংরেজি শিক্ষার আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন তিনি।

ইউল্যাবের ট্রাস্টি বোর্ডের উপদেষ্টা অধ্যাপক ইমরান রহমান মনে করেন, প্রযুক্তির এ যুগে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের এগিয়ে নিতে পারে অনেকখানি

ইউল্যাবের ট্রাস্টি বোর্ডের বিশেষ উপদেষ্টা অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, প্রায় ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ বা ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখতে পেয়েছেন তিনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি পড়ে আসছে। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম বর্ষ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ পর্যন্তও তাদের নতুন করে ইংরেজি শেখাতে ব্যয় করছি। এটা সময়ের অপচয়।”

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অধ্যাপক ইমরান বলেন, “বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাইভা নিতে গেলে প্রথম যে বিষয়টি ভাবতে হয়- এরা ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ঠিকমত বুঝতে পারবে কি-না, সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবে কি-না।”

এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সরকারের তরফ থেকে বড় ধরনের নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

প্রতিটি পেশায় ইংরেজি ভাষার ওপর আলাদা ধরনের দখল থাকতে হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও তেমন হওয়া দরকার বলে মনে করেন ইউল্যাবের সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজের পরিচালক এটিএম সাজেদুল হক

ইউল্যাবের সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজের পরিচালক এটিএম সাজেদুল হক বলেন, “বাংলাদেশে আমরা ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্বের কথা সব সময়ই বলি। কিন্তু একই ধরনের ইংরেজি শিক্ষা যে সবার ক্ষেত্রে উপযোগী নাও হতে পারে, সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কতটা ভেবেছি?”

তিনি বলেন, একজন কূটনীতিবিদের যে ধরনের ইংরেজি জানা দরকার, একজন বৈমানিক বা বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে তার ধরনটা এক নয়। প্রতিটি পেশার জন্যই ইংরেজি ভাষার ওপর আলাদা ধরনের দখল থাকতে হয়।  

“আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের যদি আমরা সফল পেশাজীবী হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে চাই, তাহলে তাদের যা প্রয়োজন, আর আমরা যা শেখাচ্ছি, তার মধ্যে ব্যবধানটা আমাদের দূর করতে হবে।”

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক এইচ এম জহিরুল হক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চীনের সারে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের সেন্টার ফর অ্যাকাডেমিক ইংলিশ স্টাডিজের পরিচালক মার্ক কারজানোভস্কি, যিনি প্রায়োগিক ইংরেজি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষায় কেবল বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দিলে চাকরি জীবনে সমস্যা হবে, কেননা ভাষাগত যোগাযোগের বিষয়টি তখন সামনে চলে আসবে। এ সমস্যা কাটাতে মাস্টার্স কিংবা অন্য কোর্সে নির্দিষ্ট বিষয়ের পাশাপাশি যোগাযোগের জন্য প্রায়োগিক ইংরেজি পড়াতে হবে।

দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন শেষে অতিথিদের সঙ্গে আয়োজকরা

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) চীনের সারে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের মার্ক কারজানোভস্কি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক

এ প্রসঙ্গে কিউবার মেডিকেল শিক্ষা পদ্ধতির উদাহরণ টানেন কারজানোভস্কি। সেখানে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা পেশার উপযোগী ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক আছেন। কিউবার ভাষা স্প্যানিশ, কিন্তু তাদের ডাক্তাররা আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। সেসব দেশের অনেকে ভাবেন, কিউবার ডাক্তাররাই হয়ত সবচেয়ে ভালো।

ইংরেজি ভাষা শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় ফিলিপিন্স প্রতিবছর জাপান, যুক্তরাজ্য, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে সাত থেকে আট হাজার প্রশিক্ষিত নার্স পাঠাতে পারছে বলে জানান কারজানোভস্কি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আগে দেখতে হবে কোনো খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। সেটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ওই খাতের জন্য প্রায়োগিক ইংরেজি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। যেমন অনেক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে নির্মাণ কাজে শ্রম দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপযোগী ইংরেজি শেখালে ভালো ফল আসতে পারে।

দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ‘ইংলিশ ফর স্পেসিফিক পারপাজেস’ বিষয়ে মোট ২৯টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রাশিদ খান, সহ সভাপতি আরিফা রহমান, ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের পরিচালক (এক্সামিনেশনস) সেবাস্টিয়ান পিয়ার্স, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের প্রেসিডেন্ট  ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ শরীফ, অস্টিউট হর্সের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহাদাত হোসেন, রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (মিডিয়া, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি) ইকরাম কবীর, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন।