২০১৭: শান্ত ক্যাম্পাসে দ্বন্দ্বে শিক্ষকরা

ছাত্র সংগঠনগুলোর কারণে ২০১৭ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থির অবস্থা তৈরি না হলেও বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়াতে দেখা গেছে শিক্ষকদের।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2017, 03:17 AM
Updated : 30 Dec 2017, 07:38 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে উত্তাপ ছিল বেশি উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে; অনেক বিতর্কের মধ্যে উপাচার্য পবিবর্তনের পর এক শিক্ষকের ‘নাক ফাটানোর’ ঘটনাও ঘটেছে।

‘অনিয়মের’ বিরোধিতা আর বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে বছরের বড় একটা সময় নিজ কার্যালয়েই বসতে পারেননি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলী আশরাফ। আন্দোলনের কারণে স্থগিত করতে হয়েছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি ভর্তি পরীক্ষাও।

চার বছর দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের করা তদন্ত প্রতিবেদনে নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে এ বছর মেয়াদ শেষ করেন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী।

এক শিক্ষককে অব্যাহতি ও রেজিস্ট্রার কর্তৃক তিনি লাঞ্ছিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আন্দোলনে নামে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা; পরে শিক্ষককে বহাল ও রেজিস্ট্রারকে ছুটিতে পাঠানো মাধ্যমে ক্লাসে ফেরেন তারা।

বছরের শেষের দিকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করে আলোচনায় আসেন সাবেক এক শিক্ষার্থী; তবে শেষ পর্যন্ত কেবল আশ্বাস নিয়েই অনশন ভাঙতে হয় তাকে।

শিক্ষকদের মধ্যে এ ধরনের বিরোধ ও দ্বন্দ্বকে ‘অপ্রত্যাশিত, দুঃখজনক ও অবাঞ্ছনীয়’ বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমিও শিক্ষক রাজনীতি করেছি। কখনও আমরা শিক্ষক রাজনীতিকে বিরোধ বলি নাই। আমরা পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছি, প্রতিপক্ষও বলি নাই। নির্বাচন করেছি, হেরেছি, জিতেছি- সেটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কের ঘাটতি-অবনতি সেটা খারাপ হয়নি।

“এখন দুয়েকটা ক্ষেত্রে হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। এটা কখনও হওয়া উচিৎ নয়।”

শিক্ষকদের মধ্যে এ ধরনের বিরোধ থাকলে সেটা ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ উভয়ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।

“যেখানে শিক্ষকরা এই রকম করেন, ছাত্ররাই বা কি শিখবে? এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত, হওয়া উচিতও না। আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, কেউ যদি বলে প্রতিপক্ষ, সেটা থাকবে। তার মানে এই না আমরা নিজেরা নিজেরা সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি করব। এটা একেবারে অবাঞ্ছনীয়।“

২০১৭ সালে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার পরিবেশ ‘ভালোর দিকটা বেশি’ ছিল দাবি করে অধ্যাপক মান্নান বলেন, “কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনির্ধারিত ছুটিতে বন্ধ হয় নাই। আর শিক্ষাঙ্গনে যে একটা সন্ত্রাস আগে ছিল, মারামারি ছাত্রদের মধ্যে সেটি বস্তুতপক্ষে হয়ইনি। কোন কোন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে হয়েছে, সেটা ক্যাম্পাসের বাইরে, আগের মতো প্রতিনিয়ত পত্রিকা খুললেই যেটা দেখা যেত, সে রকম হয়নি। আমরা সেটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের মধ্যে নানা রকম বিরোধে ২০১৭ সালে নতুন উপাচার্য পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

৪ সেপ্টেম্বর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের স্থলে নতুন উপাচার্য হিসাবে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।

নির্বাচন ছাড়াই সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৩ সালের ২৪ অগাস্ট সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে আরও চার বছরের জন্য নিয়োগ পান অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক। তার সেই মেয়াদ শেষ হয় গত ২৪ অগাস্ট।

তার মেয়াদ পূর্তির আগে আগে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্ধারণ বা নির্বাচন না করেই ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভা ডাকা হলে তাতে আপত্তি জানিয়ে আদালতে রিট আবেদন করেন ১৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট।

ওই আবেদনে হাই কোর্ট সিনেট সভা স্থগিত করে রুল দিলেও চেম্বার আদালতে হাই কোর্টের আদেশ আটকে যায়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী ধস্তাধস্তি

এরপর গত ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভবনে সিনেটের সভা বসে। বিএনপিপন্থি সমর্থকদের বর্জন, সরকার সমর্থকদের একাংশের আপত্তি এবং শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে ওই সভায় ভোট ছাড়াই উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত করা হয়।

বিকল্প কোনো প্রস্তাব সভায় না আসায় অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও নীল দলের আহ্বায়ক আবদুল আজিজকে নিয়ে তিন সদস্যের প্যানেলই ‍সিনেটের অনুমোদন পায়।

নিয়ম অনুযায়ী ওই তিনজনের মধ্য থেকেই একজনকে পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রপতির। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ৩ অগাস্ট সিনেটে মনোনীত ওই প্যানেলের পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়।

রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্ধারণ না করেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেটের বিশেষ সভা ডাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্ট যে রুল দিয়েছিল, তা চার সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলে আপিল বিভাগ।

সেই আদেশে বলা হয়, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকই উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাবেন।

এর মধ্যে নতুন উপাচার্য পাওয়ার পর অক্টোবরে ওই রুলের নিষ্পত্তি করে আরেফিন সিদ্দিকের সময়ে করা উপাচার্য প্যানেল অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট।

সেপ্টেম্বরে উপাচার্য পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও প্রক্টরিয়াল বডিসহ বিভিন্ন পদে পরিবর্তন আসে।

নতুন উপাচার্য আসার কিছু দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের সভায় প্রক্টর গোলাম রাব্বানীসহ কয়েক সহকর্মীর আঘাতে আহত হন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আ খ ম জামাল উদ্দীন। সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের ‘অনিয়ম’ নিয়ে সভায় আলোচনা ওঠার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

গেল বছরে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে প্রশাসনিক কাজ সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে; উপাচার্য অধ্যাপক আলী আশরাফের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগে বছর জুড়ে আন্দোলনে ছিল শিক্ষক সমিতি।

শিক্ষকরা তালা মেরে দেওয়ায় মার্চের ৮ তারিখ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত নিজ কার্যালয়ে যেতে পারেনি উপাচার্য। পরে সমর্থক শিক্ষক ও ছাত্রলীগের সহায়তায় ২০ মার্চ তালা ভেঙ্গে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন তিনি।

এরপরও উপাচার্যের বাড়তি ভাতা নেওয়া, শিক্ষকদের ওপর হামলার বিচার, প্রক্টরের পদত্যাগসহ ১৪ দফা দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন কর্মসূচি চলার মধ্যে ১৫ অক্টোবর থেকে দায়িত্বের শেষ সময় ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আর কার্যালয়ে যেতে পারেননি তিনি।

বাসভবন থেকে অধ্যাপক আলী আশরাফের দাপ্তরিক কাজ সারার মধ্যে ১৭ ও ১৮ নভেম্বরের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটিকে।

বছরের শেষ সময়ে উপাচার্যবিহীন অবস্থায় পার করতে হয়েছে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

অতিরিক্ত আপ্যায়ন খরচ, ভর্তি পরীক্ষার সম্মানি হিসেবে ‘অনৈতিকভাবে’ বিপুল অংকের অর্থগ্রহণসহ বিভিন্ন অভিযোগ মাথায় নিয়ে ৫ মে মেয়াদ শেষ করেন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী।

শিক্ষক সমিতির অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) করা তদন্তে সেগুলো ‘প্রমাণিত’ হওয়ার পর চার বছরের মেয়াদ শেষ হয় অধ্যাপক নূর-উন নবীর।

মেয়াদ শেষ করার দু’দিন আগে চাকরি দাবিকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ১৩ ঘণ্টার অবরোধে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ থেকে প্রেষণে যাওয়া এই অধ্যাপক। পরে পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার হতে হন তিনি।

পরবর্তীতে ১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে নতুন উপাচার্য হিসাবে পায় উত্তর জনপদের এই বিশ্ববিদ্যালয়।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্ব, অন্ধ হলেন সিদ্দিকুর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে নানা জটিলতায় বছর পার করেন রাজধানীর সাত কলেজের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাবির বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলেও সমাধান না আসায় অধিভূক্তির কার্যক্রম পিছিয়ে যায়; এ নিয়ে পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে বেকাদায় পড়ে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের মধ্যে পুরোনো দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতি জটিলতার দিকে যায় বলে গণমাধ্যমের খবর।

এর মধ্যে ২০ জুলাই পরীক্ষার রুটিনসহ পাঁচ দফা দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভের সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসের শেলে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান।

সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ে নেওয়া হলেও দুই চোখেই আলো পাননি সিদ্দিকুর, পরবর্তীতে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডে (ইডিসিএল) 'টেলিফোন অপারেটর' পদে চাকরি দেওয়া হয় তাকে।