পুনর্মিলনে স্মৃতির সন্তরণ

জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদে ফেলে আসা স্মৃতির টানে কার্জন হলের সবুজ প্রাঙ্গণ মুখর করেছেন ঐতিহাসিক ফজলুল হক হলে শিক্ষাজীবন পার করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2017, 12:34 PM
Updated : 19 May 2017, 05:32 PM

দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক হলটির নবীন-প্রবীণরা আড্ডায়-গল্পে সোনালি দিনের স্মৃতি রোমন্থনে পার করেছেন পুরোদিন।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে জড়ো হতে থাকে ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক হলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

১৯৪৯ সালের প্রবীণ থেকে শুরু করে বর্তমানের সদ্য পাস করা ছাত্ররা অংশ নেয় ‘ফজলুল হক হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী ও প্রথম সাধারণ সভায়’।

প্রিয় প্রাঙ্গনের কাটানো দিনগুলো যেন আবার ফিরে পেয়েছে তারা।

গল্প-আড্ডা ছবি তোলা, কুশল বিনিময় ও স্মৃতিচারণার আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে হাজারো প্রাক্তনরা। এর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত অনেক সাবেক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

১৯৪৯-৫০ সালের শিক্ষার্থী প্রবীণ অধ্যাপক কাজী আবদুল ফাত্তাহর সভাপতিত্বে এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান শুরু হয়।

প্রখর রোদে সবুজ প্রাঙ্গণে সবাইকে পেয়ে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আজ খুব ভালো লাগছে, এত দিন পরে সবাইকে একসঙ্গে পেয়েছি। স্মৃতিতে ভাসছে সেই পুরোনো অতীত, ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলির কথা। সুযোগ হয়েছে পরস্পরের মধ্যে এই মেলবন্ধনের।”

১৯৫০-৫১ সালের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেনের এখন হাঁটতে কষ্ট হয়। বয়সের ভারে কথা ভেঙে যায় তার; কিন্তু স্মৃতির টানে জুনিয়রদের দেখতে এসেছেন তিনিও।

আফজাল হোসেন বলেন, “কাজী আবদুল ফাত্তাহ আগে ভর্তি হলেও বয়সে আমি একটু জ্যেষ্ঠ। এখানে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এখানে উপস্থিতদের মধ্যে আমি সিনিয়র। আজ বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে, আমার কথাও থেমে যাচ্ছে।”

সবাইকে পেয়ে নিজের আনন্দের অনুভূতি প্রকাশে ভুলেন নি তিনি।

“এখানে আসার পর গরমে বসে থাকতে হচ্ছে। একবার ভাবলাম চলে যাব। কিন্তু পরে ভাবলাম যখন এসেছি, গরম উপেক্ষা করেই জুনিয়রদের সময় দেই, দেখা করি, আড্ডা দেই তাদের সঙ্গে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফজলুল হক হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “আজ আনন্দের দিন। এই মিলন মেলার সুযোগে প্রিয় হলেও একবার ঘুরে যাবেন। এখানে আমরা কাটিয়েছি উত্তাল সময়, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী আমরা।”

তিনি জানান, সেই ভাষা আন্দোলন, প্রতিবাদ এখান থেকে শুরু হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে সেই মিছিল হবে কিনা, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো ঐতিহাসিক ফজলুল হক হলের পুকুর ঘাটে।

পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ও হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, “আমার দুটি মেয়ে সন্তান আছে। আমার ছেলে সন্তান না থাকায় হলের ছাত্রদের নিজের ছেলে মতো দেখতাম। আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়াতে অবদান রাখছে। এটা আনন্দের ও গর্বের বিষয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “এখান থেকে পড়ালেখা শেষ করে আপনারা দেশ পরিচালনায় কর্মরত আছেন। এখানে উপস্থিত হয়ে আপনাদের মতো অগ্রজদের কাছ সেই অনুপ্রেরণা নেবে অনুজরা।”

এই হলের পাশ দিয়ে গেলেই হলে থাকার স্মৃতি ভেসে উঠে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের।

তিনি বলেন, “আমি হলের ১৯ নম্বর কক্ষে ছিলাম, এক রুমে চারজন থাকতাম। তিনজন স্ব স্ব কাজে পারদর্শী ছিলেন, একজন ছিলেন ফুটবলার, একটজন ক্রিকেটার ও আরেকজন অ্যাথেলেট। সবাই পড়াশুনায় অত ভাল ছিল না। আমিও তাদের মতোই ছিলাম। তবে আমি অর্থনীতি বিভাগের হওয়ায় একটু বেশি পড়তে হত।

“আমি রুমমেটদের খেলা দেখতাম, ফুটবল খেলায় গিয়ে দেখলাম আমার রুমমেট খেলছেন। আর দুই রুমমেটকে নিয়ে গ্যালারিতে বসে আছি। তখন আনন্দ করতাম বেশি বেশি। আনন্দের বর্হিঃপ্রকাশ হিসেবে দুই রুমমেটের পিঠে মারতাম, হইহুল্লা করতাম। পরে তারা রুমে এসে আমাকে বকাঝকা করত।”

সেক্রেটারিয়েট ভবনের পাশের খাবার দোকানগুলোতে বাজানো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের মধ্য দিয়ে সকালে ঘুম ভাঙতো এইচ টি ইমামের।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, “খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছি। এখানে বসে কবিতা লিখি, সেই কবিতাগুলো অমর স্মৃতি হবে কিনা জানি না। তবে এ হলে বসেই ছাত্রলীগের শিক্ষা শান্তি প্রগতির যে গান, সেটি রচনা করেছিলাম।”

হলের ১৯৬৬-৬৭ সালের শিক্ষার্থী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এই বছরে। সেটা ছিল ছয় দফা আন্দোলনের মুহূর্ত।

“বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এই দেশের আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে অনেক সংগ্রাম হয়েছে, সেই সব সংগ্রামে মিছিল বের হত এই হল থেকে। এই সময় হলের অনেক শিক্ষার্থীকে জেল জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তখন হলের সামনে ঘাড়ে ব্যাগ, কাঁধে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের। যেন হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হতে না পারে।”

ঊনসত্তরের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “এই সময় ঢাকা শহর ছিল আন্দোলনে উত্তাল। পরে সত্তরের নিবার্চন, সাতই মার্চের ভাষণ, ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা। সবখানে আমাদের সম্পৃক্ততা ছিল, এইসব ঘটেছে আমার ছাত্রজীবনের সময়ে।”

হলের ২০৬ নম্বর কক্ষে কাটানো সময় ও হলের খাওয়া-দাওয়ার কথাও স্মরণ করেন কে এম নূরুল হুদা।

নতুনদের স্বাগত জানিয়ে সিইসি বলেন, “আজ এখানে এসে নতুনদের সঙ্গে মিশছি, কথা বলছি। এ এক নতুন ধরনের প্রাপ্তি। নবীন ও পুরনো সহপাঠীদের নিয়ে আজ আনন্দে কাটাচ্ছি, এ এক অন্য ধরনের অনভূতি। অনেকেই আমরা এখনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছি, সবার সহযোগিতা কামনা করছি।”

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

এতে আরও অংশ নেন হলের সাবেক শিক্ষার্থী পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, সাবেক হল প্রভোস্ট আবু জাফর মোহাম্মদ, হল প্রভোস্ট অধ্যাপক হারুন অর রশীদ।

স্মৃতির পাঠে সাবেক শিক্ষার্থীরা পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদসহ অনেকের কথাও স্মরণ করেন।

অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটি

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে সভাপতি, পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সিনিয়র সহ-সভাপতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার মহাসচিব ও ফজলুল হক হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হারুন অর রশীদকে কোষাধ্যক্ষ করে আগামী দুই বছরের জন্য ৭১ সদস্য বিশিষ্ট ফজলুল হক হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।

বিকালে কার্জন হল প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। হলের অন্তত ১২০০ শিক্ষার্থী প্রথমবারের পুনর্মিলনীতে অংশ নিতে নিবন্ধন করেছে।

অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের নামে ১৯৪০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হলের যাত্রা শুরু হয়।

পুনর্মিলনী উপলক্ষে পুরনো এ হল সেজেছে; পাশাপাশি কার্জন হলও হয়েছে রঙিন।

যোগাযোগের ঠিকানা

অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়: ফজলুল হক মুসলিম হল

ইমেইল : fhhallalumni@gmail.com ওয়েব: www.fhdualumni.org