উঠে দাঁড়াতে বেসিক ব্যাংককে বিশেষ ছাড়

প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখার বাধ্যবাধকতা থেকে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে রেহাই দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2015, 10:18 AM
Updated : 17 June 2015, 10:20 AM

নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের মুখে ধুকতে থাকা এই ব্যাংককে উঠে দাঁড়াতে বিশেষ এই ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে বেসিক ব্যাংককে এই ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন-২০১৪ এ দেখা যায়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ১৯৩৩ কোটি টাকা একটি ব্লক একাউন্টে রেখে তার বিপরীতে ১০ বছর কোনো ধরনের প্রভিশন না রাখার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সেই সঙ্গে ২৩৬৪ কোটি ও ১৩৭ কোটি টাকা আলাদা দুটি হিসাবে রাখা যাবে, যার বিপরীতে ৫ বছর ধরে প্রভিশন রাখা লাগবে না।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা সব ব্যাংকের উপরই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকই খেলাপি ঋণের ধরন (এসএমএ, সাব স্টান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড-লস) ভেদে প্রভিশনের হার নির্ধারণ করে।   

‘ব্যাড-লস’ বা মন্দ ও কু মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ ভাগ প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে।

এই ছাড় পাওয়ায় বেসিক ব্যাংকের এসব খেলাপি ঋণ এখন আর ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতির মধ্যে ধরা হবে না। অর্থাৎ ব্যাংকটির ঋণ হিসাব থেকে এই প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাবে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতকারীদের অর্থ এভাবে ব্যাংকের হিসাব থেকে বাইরে রাখা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে ব্যাংকও ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ ঋণই ব্যাংকের সম্পদ, আর আমানত হচ্ছে ব্যাংকের দায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রভিশন রাখার বিষয়ে বেসিক ব্যাংককে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়মের মধ্যে থেকেই হয়েছে।

“ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রভিশনে তাদের সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময় দেওয়া না হলে ব্যাংকটি দাঁড়াবে কীভাবে?”

ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “অনেক ঋণ ছিল, যেগুলোর নথি ছিল না, সেগুলোকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। আবার অনেক ঋণ ছিল, যেগুলোর গ্রাহক ছিল না, সেগুলোর গ্রাহক সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৬৩০৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৫৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৮৪৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

মার্চ প্রান্তিকে এসে ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৮ হাজার ৯৬৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৭৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা খেলাপি, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে আলাদা করার পরও ব্যাংকটির ৫ হাজার ৭৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে আর মন্দ বা কু মানের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ৮০ টাকা, যা মোট ঋণের ৪০ দশমিক ২০ শতাংশ।      

তিন মাসের ব্যবধানে বেসিক ব্যাংকের ঋণ স্থিতি কমে গেছে ২ হাজার ৮৭৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার মো. ইকবালের মতামত জানতে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান কাজী ফখরুল ইসলাম।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির রাজধানীর শান্তিনগর, গুলশান, দিলকুশা শাখার মাধ্যমে প্রায় ৪৬০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম ধরা পড়ে।

এরপর ঋণ অনিয়মের সাথে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততার প্রমাণও পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

তার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী ফখরুলকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পাশাপাশি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদেও একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেওয়ার পর আব্দুল হাই বাচ্চু নিজেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।