আইজিডব্লিউ ব্যবসা কুক্ষিগত করতে ছক

বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের অপারেটর আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) ব্যবসা কুক্ষিগত করতে একচেটিয়া কারবারের ছক কষেছেন ব্যবসায়ীদের একটি অংশ।

শামীম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2014, 08:39 AM
Updated : 4 Dec 2019, 12:26 PM

আইজিডব্লিউ অপারেটররা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সাতটি বাদে সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধের দিকে ধাবিত হবে।

ব্যবসা কুক্ষিগত করতে এই ছক বাস্তবায়িত হলে এই খাতে শতশত কোটি টাকা অনৈতিকভাবে লেনদেন হবে বলেও আশঙ্কা করছেন জোটে আসতে অঙ্গীকারাবদ্ধ ফোরামের সদস্য ও আইজিডব্লিউ কোম্পানিগুলো।

বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা ও আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি দলের কয়েকজন নেতা মিলে এ পরিকল্পনা করেছেন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) নামে একটি সংগঠন তৈরির প্রস্তাবে সায় দিয়ে তা অনুমোদনের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

বিটিআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকটা চাপে পড়েই তাদের এ কাজ করতে হয়েছে।

লাইসেন্স নীতিমালা অনুযায়ী, আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের আওতায় থাকার কথা থাকলেও দুটি অসম স্তরে ভাগ করা হয় এই পরিকল্পনায় [টিয়ার-১ (১৬টি) ও টিয়ার-২ (৭টি)]।

২৮ সেপ্টেম্বর এইকসঙ্গে বিটিআরসি তাড়াহুড়ো করে টিয়ার-২ এর (আইওএস সুইচ পরিচালনাকারী) সাতটি আইজিডব্লিউর এর নাম চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

ওই সাতটি প্রতিষ্ঠান হল- ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স, রুটস কমিউনিকেশন্স, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম।

এই সাত আইজিডব্লিউর মধ্যে মীর টেলিকম, নভো টেলিকম ও বাংলা ট্র্যাক পুরনো প্রতিষ্ঠান।

বিটিআরসি লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, ইউনিক ইনফোওয়ে মালিকানায় রয়েছেন বিএনপি নেতা জিএম সিরাজের স্ত্রী শাহনাজ সিরাজ।

আবদুস সোবহান গোলাপ

২০১২ সালে ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সুপারিশে লাইসেন্স পায়। কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মতে, সেই আত্মীয় তার ভাতিজা সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস।

বিটিআরসির রাজস্ব না দেওয়ায় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ব্লক করা হয়েছিল।

রুটস কমিউনিকেশন্স প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক মালিকানায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের স্ত্রী গুলশান আরা।

গ্লোবাল ভয়েস মালিকানায় রয়েছেন একেএম শামসুদ্দোহা। এই কোম্পানিতে ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান রহমানের সরাসরি মালিকানা না থাকলেও স্বার্থ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

শায়ান রহমান

বিটিআরসিতে আইজিডব্লিও ফোরামের একাধিক বৈঠকে শায়ানকে দেখা গেছে।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে (যা বিডিনিউজ টোয়েণ্টিফোর ডটকমের হাতে রয়েছে) দেখা যায়, মোট ২৩টি আইজিডব্লিউর মধ্যে ১৮টিকে এই সংগঠনের আওতায় নেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ী বলছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা চাপ সৃষ্টি করেই তাদের এ পরিকল্পনায় নিয়ে আসা হয়েছে।

বিটিআরসি থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যে থেকে শেষ ছয় মাস (মার্চ-অগাস্ট) সর্বাধিক কল টার্মিনেশন, শেষ ছয় মাসে (জানুয়ারী-জুন) সর্বাধিক রাজস্ব আনায়ন, বকেয়া পরিমাণ বিবেচনাসহ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে ওই সাত প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে।

এই পরিকল্পনা বাস্তাবায়নে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর  সঙ্গে শেয়ারবাজার কারসাজির এক নেতা মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার সাক্ষাৎ  করেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। তবে তার নাম তারা বলেননি।

বিটিআরসিতে কয়েক দফা বৈঠক চলে কয়েক মাস ধরে। শেষ পর্যন্ত চাপ সৃষ্টি করে ফোরামের নিয়ে আসা হয় ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে।

এই চাপ সৃষ্টিতে অংশ নিচ্ছেন অন্যান্যের মধ্যে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত একজন মন্ত্রী। অন্য একজন বড় ব্যবসায়ী এবং আরেকটি আইজডব্লিউ কোম্পানির মালিক তা নিশ্চিত করেছেন। ওই ব্যবসায়ী এটাও বলেছেন, তিনি ওই মন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পরিকল্পনা মডেল অনুযায়ী, বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের সব লেনদেন হবে ‘টিয়ার-২’ এর একটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। অন্য অপারেটর কল আদান-প্রদানের সব অর্থ হস্তান্তর করবে টিয়ার-২ এর মাধ্যমে। পরে টিয়ার-২ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (বিটিআরসি, আইসিএক্স ও এএনএস) কাছে রাজস্ব হস্তান্তর করবে।

লাইসেন্স নীতিমালা অনুযায়ী, আইজিডব্লিউ তাদের রাজস্বের ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ আইসিএক্স এবং ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এএনএসের কাছে পরিশোধ করে থাকে।

পরিকল্পনায় টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ এর লভ্যাংশ ভাগাভাগির হার ধরা হয়েছে ১:১.৯০। একই ব্যবসা হলেও টিয়ার-২ এর প্রায় দ্বিগুণ আর্থিক লাভ করার সুযোগ থাকছে। অর্থাৎ, টিয়ার-১ যদি পায় এক টাকা, তাহলে টিয়ার-২ পাবে এক টাকা ৯০ পয়সা।

প্রতি দুইমাস পরপর আইজিডব্লিউগুলো রাজস্ব দিয়ে থাকে। টিয়ার-২ এই অর্থের যে সুদ হবে তাও উপরি আয় করবে এবং বিলম্ব করে এই আয় আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অপারেটরা; যার পরিমাণ হবে কয়েকশ’ কোটি টাকা।

বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক কল আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এ টাকার পুরোটাই চলে যাবে টিয়ার-২ এর নিয়ন্ত্রণে।

এ সেক্টর থেকে সরকার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে।

প্রস্তাবিত মডেলে রাজস্ব আহরণে টিয়ার-১ থাকা কোম্পানিগুলোর মাসে তিন মিলিয়ন (৩০ কোটি) মিনিট কল আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

অপারেটররা মনে করছেন, টিয়ার-২ দ্বিগুণ রাজস্ব পাওয়ায় তারা ডিসকাউন্টে কল আনবে, ইচ্ছা করলেই তারা কম দামে কল আনতে পারবে। এর ফলে সাত অপারেটর বাদে অন্য সবার ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্স’ নামে একটি একাউন্ট থাকবে। তবে এ খাতটি কিভাবে কাজ করবে বা কত টাকা দেওয়া হবে, তা চিঠিতে বলা হয়নি।

মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্স নামে এই খাত থেকেও কোটি কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ থাকবে বলেও অভিযোগ করেন একাধিক অপারেটর।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লাইসেন্স নীতিমালার যেসব মৌলিক ধারা ও আইনি বাধা রয়েছে তা সংশোধনের জন্যও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনও চাওয়া হয়েছে।

এ সিন্ডিকেটে অংশ নেয়নি বাংলা টেল, বিজি টেল, সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ডিবিএল নামের আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান।

সিন্ডিকেটে অংশ না নেওয়া বাংলা টেল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ পরিকল্পনার মাধ্যমে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নষ্ট করা হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে টিয়ার-২ ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।

“১৫ কোটি টাকা দিয়ে এই লাইসেন্স নিয়েছি। সব মিলিয়ে বছরে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা লাইসেন্স ফি দিতে হচ্ছে। একই হারে লাইসেন্স ফি ও রাজস্ব দিতে হলে কেন এ বৈষম্য করা হবে?”

বিজি টেল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লাইসেন্স গাইড লাইন ভায়েলেট করে এ ছক করা হয়েছে, এর ফলে বাজারে কোনও প্রতিযোগিতা থাকবে না।”

“এ ব্যবসায় বিটিআরসির সাথে রাজস্ব ভাগাভাগির বিষয়টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে করা হয়, ব্যাংকিং সিস্টেমে এ লেনদেন করলে স্বচ্ছতা আসবে,” বলেন তিনি।

সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সিইও সৈয়দ মো. কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে চার প্রতিষ্ঠান আমরা এ ফোরামে যোগ দেইনি, আমাদের বক্তব্য একই যে এর ফলে এ ব্যবসা কুক্ষিগত হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে প্রস্তাবিত টিয়ার-২ এর অংশ নেওয়া গ্লোবাল ভয়েসের চেয়ারম্যান একেএম শামসুদ্দোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে করতে সবাই মিলে এই প্রস্তাব করা হয়েছে, মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলেই তা কার্যকর হবে।”

তবে সিন্ডিকেট বা বাজার কুক্ষিগত করার বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি টিয়ার-২ এই অংশীদার।

“তবে এই আইজিডব্লিউ অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) কার্যকর হলে সেক্টরে উন্নতি হবে,” দাবি করেন শামসুদ্দোহা।

টেলিযোগাযোগ সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব বিটিআরসি থেকে এসেছে শুনেছি, তবে প্রস্তাবটি এখনও দেখা হয়নি।”

তবে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “ইতোমধ্যে এ প্রস্তাবে ১৬টি নেগেটিভ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।”

বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস দেশের বাইরে রয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবীব খান এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিটিআরসি এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের অগাস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন আইজিডব্লিউ অপারেটরদের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

বিটিআরসি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি মিনিটের আন্তর্জাতিক কলের বাজার রয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলসহ বাংলাদেশে মোট আইজিডব্লিউ সংখ্যা ২৯টি। এর মধ্যে ২৩টি কাজ চালাচ্ছে।

২০১২ সালে ২৫টি নতুন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। বাজার যাচাই না করেই অতিরিক্ত লাইসেন্স দেওয়ায় ব্যবসা নিয়ে সমস্যায় পড়ার অভিযোগ আগেই করে আসছিলেন অপারেটররা।