মড়কে-অবরোধে আলু চাষীর মাথায় হাত

প্রচণ্ড কুয়াশায় মড়ক ছড়িয়ে পড়ার পর হরতাল-অবরোধে মাঠের আলু বাজারে পৌঁছাতে না পেরে এবার বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন আলু চাষীরা।

ফয়জুল সিদ্দিকীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2014, 07:48 AM
Updated : 19 Jan 2014, 01:40 PM

বাধ্য হয়ে যে দামে তাদের আলু বিক্রি করতে হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না।   

দেশের সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয় বৃহত্তর রংপুরে। এ বিভাগের নীলফামারী সদর উপজেলার ইটাখোলা ইউনিয়নের কৃষক ইসতিহাক আহমেদ এবার আলু চাষ করেছেন পাঁচ বিঘা জমিতে।

এবার তার মোট খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। আলু পেয়েছেন ৯ টন (৯ হাজার কেজি)। তার হিসেবে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় টাকার উপরে।   

প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার মাত্র তিন টাকা কেজিতে ছাড়ছি, এখন আমরা কি করি কন।”

সব মিলিয়ে এবার আলু চাষে প্রায় তেত্রিশ হাজার টাকা ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে জানান ইসতিয়াক।

তিনি জানান, গত বছর এই সময় আলুর দাম ছিল সাত থেকে আট টাকা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বল জানা যায়,  ক্ষেতে ব্লাইটরোগ দেখা দেয়ায় আলু গাছ মরে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ওষুধ দিয়েও রক্ষা পাচ্ছে না ক্ষেতের আলু।

নীলফামারী সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের কৃষক হর্ষবর্ধন রায় জানান, মড়ক ধরার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি অফিসারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দেয়ায় তার আলুর ক্ষেত রক্ষা পায়। তবে আলু বিক্রি করে তারও উৎপাদন খরচ ওঠেনি।

“সোমবার ৪ টাকা করে ৫ টন আলু বিক্রি করছি। আড়াই বিঘা জমির আলু বিক্রি করে দশ হাজার টাকা লস।”

নীলফামারী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ উপ-পরিচালক এসএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, মড়ক এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কৃষকরা পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষধ দিচ্ছেন।

সিরাজুল বলেন, আলুক্ষেতে রোগ দেখা দেয়ায় কৃষকরা সবাই একসঙ্গে আলু তুলে ফেলেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে হরতাল-অবরোধে তা আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো যায়নি। স্থানীয় বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় আলুর দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে, কৃষক বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে রাজধানীর আলুর বাজারের চিত্র ভিন্ন। ঢাকায় আলুর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার সদরঘাটের শ্যামবাজার। এখানেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলু আসে, পরে অন্যান্য বাজারে যায়।

গত বৃহস্পতিবার সকালে এই বাজার ঘুরে দেখা যায়, আরত ব্যবসায়ীরা ১৫ থেকে ১৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতার কাছে।

আর বৃহস্পতিবার ঢাকার নবাবগঞ্জ বাজারে খুচরো দোকানে আলু বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা কেজি দরে।

মাঠে কৃষক পাঁচ টাকাও দাম পাচ্ছেন না, অথচ ঢাকার পাইকাররা চার থেকে পাঁচগুণ দামে আলু বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নে শ্যামবাজারের ‘মায়ের দোয়া’ আরতের সহিদুল ইসলাম বলেন, “ট্রাক পাওয়া যায় না। আগে ট্রাক ভাড়া ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজার। এখন ট্রাক ভাড়া ৮০ হাজারের ওপরে। তবুও আতংকে কেউ ট্রাক বের করে না।”

তাছাড়া ঢাকায় আলু আসতে সময় লেগে গেলে পঁচে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) বাজার দরের তালিকায় শুক্রবার প্রতি কেজি আলুর খুচরা মূল্য দেখানো হয়েছে ১৪ থেকে ১৬টাকা, যা গত সপ্তাহেও ১৮ থেকে ২০ টাকা ছিল।

টিসিবি বলছে, ঢাকার বাজারে ১৭ জানুয়ারি থেকে আলুর দাম কমতে শুরু করেছে, যদিও সব বাজারে তার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহিল বাকি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রচণ্ড কুয়াশায় বাতাসের আদ্রতা বেড়ে যাওয়ায় এবং তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ফাইটোফথেরা ইনফ্যাস্টেন্স নামের ছত্রাকের সংক্রমণে আলুগাছে মড়ক দেখা দেয়।

আক্রান্ত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আলু ক্ষেতে মহামারি আকারে রোগ ছড়িয়ে পরে এবং গাছ মরে যায়। আগে থেকেই চার দিন অন্তর ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে এ রোগ ঠেকানো যায়।

অধ্যাপক বাকি বলেন, সব কিছু মিলিয়ে এ বছর আলুচাষীরা চরম দুর্দশায় পড়েছেন। মূলত একসঙ্গে আলু উত্তোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষক পর্যায়ে দাম পড়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে কৃষকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট দামে আলু কিনে স্থানীয় হিমাগারে রেখে চাষীদের সহায়তা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর চার লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ৮৬ লাখ ৫০ হাজার টন আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

কিন্তু জমির হিসেবে আলু চাষ ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর কৃষকরা চার লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছেন।

গতবছর চার লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে ৮৬ লাখ তিন হাজার মেট্রিক টন আলুর উৎপাদন হয়েছিল।   

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নীলফামারী প্রতিনিধি বিজয় চক্রবর্তী কাজল)