সঙ্কটে পড়ে সহায়তা চায় ইসলামী ব্যাংক

গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম আসার পর বড় ধরনের সঙ্কটে পড়েছে ইসলামী ব্যাংক। 

শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2013, 09:02 AM
Updated : 25 Feb 2013, 09:02 AM

বিভিন্ন শাখার গ্রাহকদের টাকা তোলার হিড়িক, বিভিন্ন স্থানে হামলায় পড়ার পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এই ব্যাংকের এলসি নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এই পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চেয়েছে ৩০ বছর পুরনো ইসলামী ব্যাংক, জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ ওঠায় যে ব্যাংকের ওপর নজর রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থেকে আন্দোলনের সূচনা পর্বে দাবি ওঠে, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসহ প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জনের ডাকও দেয়া হয়।

এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর নেত্রকোনায় বিপুল সংখ্যক গ্রাহক তাদের আমানতের টাকা তুলে নেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গ্রাহকদের টাকা তুলে নেয়ার পরিমাণও আগের চেয়ে বেড়েছে বলে অনুসন্ধানে দেখা গেছে।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে হিসাব বন্ধের ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিতে চাননি।

তিনি বলেন, “আমানত তোলা ও জমা দেয়া, হিসাব খোলা বা বন্ধ করা একটি নিয়মিত বিষয়। আজ বিকালেও দেখলাম চলতি মাসের এ কদিনে যে পরিমাণ হিসাব বন্ধ হয়েছে, তার দ্বিগুণ নতুন হিসাব খোলা হয়েছে। ফলে বিশেষ কোনো কারণে হিসাব বন্ধ হচ্ছে- তা আমি বলব না।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার লেখা একটি চিঠি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছে, যাতে সার্বিক পরিস্থিতিতে ইসলামী ব্যাংকের উদ্বিগ্ন অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে।

গত কয়েকদিনে ব্যাংকটির নেত্রকোনা, খুলনা, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন শাখা ভাংচুর করেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে এটিএম বুথও ভাংচুর করেছে জনতা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অনেকেই তাদের কাছে ইসলামী ব্যাংকের ভবিষ্যত জানতে চাইছেন।

গভর্নর আতিউর রহমানের কাছে পাঠানো ইসলামী ব্যাংকের ওই চিঠিতে সঙ্কট থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।

আবদুল মান্নান ওই চিঠিতে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক কিছু নেতিবাচক প্রচারণার জের ধরে গত কয়েকদিনে আমাদের কয়েকটি শাখা ও এটিএম বুথে হামলা ও ভাংচুর করা হয়েছে।

“এ ধরনের ঘটনা ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকদের নিরাপত্তাহীনতা ও জনমনে আস্থার সঙ্কট তৈরি এবং বাংলাদেশের সুশৃঙ্খল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুনাম ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।”

“দেশের ব্যাংকিং খাতের সুযোগ্য অভিভাবক হিসেবে উপরোক্ত বিষয়ে সদয় পদক্ষেপ এবং আমাদের ব্যাংকের করণীয় বিষয়ে আপনার সদয় নির্দেশনা কামনা করছি,” লেখা হয় চিঠিতে।  

গণজাগরণ আন্দোলনে চিহ্নিত হওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের গ্রাহকরা আমদানি-রপ্তানিতে জটিলতায় পড়ার কথা জানিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃত করে বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ওয়ালমার্টসহ পোশাক আমদানিকারক নামি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক অব আমেরিকাসহ কয়েকটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে চাচ্ছে না।

“এসব প্রতিষ্ঠান বলতে চাচ্ছে, ব্যাংকটির সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে হঠাৎ করে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রেতারা সম্পর্ক ছিন্ন করলে পোশাক রপ্তানি খাত সমস্যায় পড়বে।”

এই বিষয়টি নিয়ে পোশাক খাতের প্রধান তিনটি সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করে লিখিত আবেদনও দেন সংগঠনগুলোর নেতারা।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা বিষয়টি সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছি।”

ইসলামী ব্যাংকও নিজস্ব উদ্যোগে এই সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।

ইসলামী ব্যাংকের এমডি আবদুল মান্নান বলেন, “আমরা বিশ্বের অনেক ব্যাংকের সঙ্গেই ব্যবসা করি। কোন ব্যাংকের সঙ্গে একটু আধটু সমস্যা হতেই পারে। এটা উদ্বেগের কিছু নয়।”

তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সহায়তা চেয়েছেন কেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সহযোগিতা চাইনি। স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সবসময় কথা হচ্ছে, এটা তারই অংশ।”

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান।

আবদুল মান্নানকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি গভর্নরের সঙ্গে একান্তে আলোচনা করতে দেখা গেছে, যদিও ওই আলোচনার আগেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গভর্নরের এক বৈঠকে ছিলেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের ওই বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই গভর্নর বেরিয়ে এলে তার পিছু পিছু ইসলামী ব্যাংকের এমডিকেও বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এরপর তিনি গভর্নরের কক্ষে যান।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, টেসকো, ওয়ালমার্ট, জেসিপেনি, এইচঅ্যান্ডএম, ইনডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে অনীহা প্রকাশ করছে।

ওয়ালমার্টের কাজ করেন এমন একাধিক রপ্তানিকারক বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে কোনো লেনদেন করবে না বলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, ব্যাংকটির কোনো রপ্তানি দলিলও গ্রহণ করবে না তারা।

জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ ওঠার পর কয়েকবছর ধরেই আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

এইচএসবিসি যুক্তরাজ্য, সিটি ব্যাংক এনএ, ব্যাংক অব আমেরিকা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়।

এইচএসবিসি লন্ডন শাখা চট্টগ্রামের ফ্রেন্ডন্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অ্যাপারেলস লিমিটেডের বেশ কয়েকটি বিল (ইসলামী ব্যাংকের) গ্রহণ করেনি বলে বিজিএমইএ’র এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। গিভেন্সি গ্রুপও এ-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চেয়ে বিজিএমইএকে চিঠি দিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আগে থেকেই ছিল। ২০১০ সাল থেকেই এই ব্যাংকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে পর্যবেক্ষকের এই দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ওপর নজরদারি সম্প্রতি আরো বাড়ানো হয়েছে।

“এই ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনসাইট (সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন) ও অফসাইট (ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ) সুপারভিশন জোরদার করা হয়েছে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকে এমন কিছু হিসাব পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো সন্দেহজনক। এসব হিসাবের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ‘লুকিয়েছিল’ ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এক তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ার পর সেসব হিসাব জব্দ করে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির এক প্রতিবেদনেও।

‘দাবি এক, বাস্তব অবস্থা ভিন্ন’

গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপনের হিড়িক দেখা যাচ্ছে, যাতে ঘুরেফিরে বলা হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংক বিশেষ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান নয়।

তবে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করলে জামায়াতে ইসলামী বা এই দলের মতাদর্শের বাইরের কাউকে ওই ফোরামে দেখা যায়নি।

ব্যাংকটির এমডি আবদুল মান্নান বলেন, “ইসলামী ব্যাংক কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান নয়।

“এটি দেশের শীর্ষ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে।”

গত কয়েকদিন ধরে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) নেতৃত্বে ৭০ শতাংশ বিদেশি উদ্যোক্তাদের শেয়ার নিয়ে প্রায় ৩০ বছর আগে যাত্রা শুরু করে এই ব্যাংক। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবিসহ দেশে-বিদেশে ৬০ হাজার অংশীদার (শেয়ারহোল্ডার) রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল এর মালিক নয়।

তবে ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের তথ্যের মিল নেই। 

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিদেশি অংশীদারদের হাতে বর্তমানে প্রায় ৫৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আর আইসিবি এই ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার নয়। পুঁজিবাজার থেকে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনেছে শুধু। এ ব্যাংকে সরকারের কোনো শেয়ার নেই।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামী নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শনিবার রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনকারীরা।

গণজাগরণ মঞ্চ জামায়াত সংশ্লিষ্ট হিসেবে ইসলামী ব্যাংক বন্ধের দাবি জানানো হলেও একে ‘অপপ্রচার’ বলছেন ইসলামী ব্যাংকের এমডি।

তিনি বলেন, “একটি গোষ্ঠী বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে, আমাদেরকে একটি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমি আশা করি, খোঁজ নিলে তারা বুঝবেন।”

খোঁজ নিতে এই ব্যাংকের কর্তা-ব্যক্তিদের নামের ওপর চোখ রাখলে দেখা যায়, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সব সময়ই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আব্দুজ জাহের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম এলাকায় আল বদর বাহিনীর নেতা ছিলেন বলে  ইসলামী ঐক্যজোট নেতাদের দাবি।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার মীর কাশেম আলী ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এই সদস্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সদস্য(প্রশাসন)। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা ট্রাস্টের বোর্ডেও সদস্য হিসাবে রয়েছেন তিনি।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নানও জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

ব্যাংকটির বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. সালেহ হলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের ভাই। 

ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এর ১৯ জন্য দেশীয় ‘স্পন্সরের’ মধ্যে আট জন মৃত। তাদের উত্তরসূরি কারা বা তারা কী করেন-  সে বিষয়ে কোনো তথ্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেনি।