সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিপাকে সরকার

সঞ্চয়পত্র নিয়ে সরকারের যে উদ্দেশ্য তা পূরণ তো হচ্ছেই না, বরং যত বিক্রি হচ্ছে, সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অর্থ। আবদুর রহিম হারমাছির প্রতিবেদন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2012, 11:55 PM
Updated : 14 April 2012, 11:55 PM
আবদুর রহিম হারমাছি
প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
ঢাকা, এপ্রিল ১৫ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- সঞ্চয়পত্র নিয়ে সরকারের যে উদ্দেশ্য তা পূরণ তো হচ্ছেই না; বরং যত বিক্রি হচ্ছে, সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অর্থ।
এই কারণে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৬ হাজার কোট টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও তা পারছে না সরকার; যদিও গত আট মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণই নেওয়া হয়নি।
সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হলেও সঞ্চয়পত্রের মতো নিরাপদ এই বিনিয়োগে মানুষকে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর কোনো কারণ খুঁজে না পেলেও উৎসে কর কাটার কারণেই সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ নেতিবাচক। অর্থ্যাৎ নিট হিসাবে এই আট মাসে কোনো সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। যে পরিমাণ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার থেকে বেশি টাকা সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আট মাসের হিসাবে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এর আগে কোনো এক মাসে নিট বিক্রি নেতিবাচক থাকলেও পরের মাসগুলোতে তা পূরণ হয়ে ইতিবাচক হয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০১০-১১ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬১২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১০৮ কোটি ১১ লাখ টাকা নেতিবাচক। অর্থাৎ এই আট মাসে প্রকৃত অর্থে কোনো সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। উল্টো সরকারি কোষাগার থেকে ১০৮ কোটি ১১ লাখ টাকা এ খাতে সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে।
অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সঞ্চয়পত্র খাতে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তার থেকে ১০৮ কোটি ১১ লাখ টাকা বেশি সঞ্চয় ভেঙেছে।
এ তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক্ষেত্রে আমি তাদের (সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের) কোনো ডিস্টার্ব (বিরক্ত) করি না, কিন্তু কেন জানি না, এর বিক্রি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন মনে করেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর থেকে ৫ শতাংশ হারে কর কাটার ফলে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
উম্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “একজন মানুষ নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে মেয়াদ শেষে সুদ বাবদ যে লাভ পান, তার প্রায় অর্ধেকই চলে যায় কর পরিশোধে। তাহলে সে কেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে?”
“বিশেষ করে পেনশনারস সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ শতাংশ কর কাটা অযৌক্তিক। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযেযাগ্য নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের সঞ্চয় থেকে কর কাটা হয় না। এটা মরা মানুষের ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো,” বলেন ফরাসউদ্দিন।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে পুঁজিবাজারের একটি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের বিপুল পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে আটকে আছে। যখন বাজার ভালো ছিল, তখন অনেকেই বেশি লাভের আশায় সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু বাজারে ধস নামায় এখন আর কেউ লোকসানে শেয়ার বিক্রি করছে না।”
সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে রাখছে বলে জানান জায়েদ বখত।
তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক হওয়ায় সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিতে পারছে না। বাধ্য হয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে।
“সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে যদি সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থ সংস্থান করতে পারত, তাহলে সেটা ভাল হত। দেশের অর্থনীতির জন্যও সেটা হত ইতিবাচক,” যোগ করেন জায়েদ বখত।
গত বছরের বাজেটে পাসের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়ায়। এরপরও বিক্রি না বাড়ায় গত ১ মার্চ সুদের হার ১ দশমিক ৩৮ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
মার্চ মাসের সঞ্চয়পত্র বিক্রির হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুদের হার বাড়িয়েও বিক্রি বাড়েনি। হয়ত সামনের দিনগুলোতে বাড়বে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এআরএইচ/এমআই/১১৫০ ঘ.