বিদেশি কোম্পানির শাখা অফিসের ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হচ্ছে

রাজস্ব আদায়ের বড় খাত মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) এবার বেশ কিছু রদবদলের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী; যেগুলোর মধ্যে বিদেশি কোম্পানির শাখা ও লিয়াজো অফিসকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় দেখতে চেয়েছেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2022, 08:07 PM
Updated : 11 June 2022, 03:47 AM

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো ও কমানোর প্রস্তাবের পাশাপাশি ভ্যাটের আওতা বাড়িয়ে রাজস্বে ভূমিকা রাখতে কিছু নীতিগত পরিবর্তন আনার কথাও বলেছেন তিনি।

এজন্য মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বিধিমালা, ২০১৬ এর প্রয়োগ ও পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করতে বাজেট বক্তৃতায় ও অর্থ বিলে বেশ কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বৃহস্পতিবার বাজেট উপস্থাপনকালে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।

এর আগে ফেইসবুক, গুগল, ইউটিউব, মাইক্রোসফটের মত ডিজিটাল কোম্পানিকে ২০২০ সালের পর থেকে একে একে ভ্যাটের আওতায় আনে এনবিআর।

এসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধনের জন্য বিআইএন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) নিতে বাধ্য করে। এ খাত থেকে বড় অঙ্কের আয়ও করতে শুরু করে দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রধান সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।     

সেই ধারাবাহিকতায় এবার সব ধরনের বিদেশি কোম্পানির শাখা বা লিয়াজো বা প্রজেক্ট অফিস স্থাপনে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে ভ্যাট আইনের ধারা ৪ এর সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে অর্থ বিলে।

এ ধারা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মোট আয় (টার্নওভার) নির্বিশেষে ভাট নিবন্ধন নিতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকগুলো বড় ব্র্যান্ড ও কোম্পানি শাখা বা লিয়াজো অফিসের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এসব কোম্পানির বিআইএন নম্বর থাকলে সেগুলোর অর্থ লেনদেন এনবিআরের নজরদারিতে আসবে। রাজস্ব আয়ের পরিমাণও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২২ সালের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে এর পাশাপাশি ‘মূসক এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়াদেরও ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আর আগে থেকেই আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কারা বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের আওতায় আসবেন তা এ ধারায় বলা রয়েছে।

ভ্যাট আইনে সংশোধনের প্রস্তাব এনে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যাঞ্চ অফিস বা লিয়াজো অফিসকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আনয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নের প্রস্তাব করছি।”

সরকারের আয় বাড়াতে কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট খেলাপিদের বিরুদ্ধে যেমন কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী, তেমনি ব্যবসা সহজ করতে কিছু বিধিতে ছাড় দেওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।

তিনি বলেন, “ভ্যাট খেলাপি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণে মূসক কর্মকর্তাগণ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করার বিধান আইনে সন্নিবেশকরণের প্রস্তাব করছি।”

আবার ভ্যাটের জরিমানার সময় বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছে।

বাজেটে তিনি বলেন, “আইনে শাস্তি ও জরিমানার বিধান অতিরিক্ত কঠোর করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রায়োগিক জটিলতার সৃষ্টি করে এবং স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়।”

“সে কারণে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এ জরিমানা ও সুদের হার সহনীয় করার লক্ষ্যে প্রস্তাব পেশ করছি।”

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

বাজেটে ও অর্থ বিলে এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে

>> বকেয়া মূসক আদায়ের ক্ষেত্রে সুদ আরোপের সময়সীমা সর্বোচ্চ ২৪ মাস করা।

>> নির্ধারিত তারিখের মধ্যে মূসক বা টার্নওভার কর দাখিলপত্র পেশ না করার ব্যর্থতা বা অনিয়মের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৫ হাজার টাকা করা।

>> ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা বা অনিয়মের ক্ষেত্রে আরোপিত জরিমানার পরিমাণ জড়িত রাজস্বের ‘সমপরিমাণ’ এর পরিবর্তে ‘অন্যূন অর্ধেক এবং অনূর্ধ্ব সমপরিমাণ’ করা।

>> করদাতাদের অনিচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ না করা এবং বন্ধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করার মধ্যবর্তী সময়ে দাখিলপত্র পেশ না করা হলে জরিমানা আরোপ না করার বিধান সংযোজন।

>> আপিল কমিশনারেট, আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালতে আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে আরোপিত জরিমানা বাদে শুধু দাবী করা করের অংশবিশেষ জমা প্রদানের বিধান করা।

>> আপিলাত ট্রাইব্যূনালে নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠান আপিল দায়ের করতে না পারলে মেয়াদ আরও ৬০ দিন বর্ধিত করার বিধান সন্নিবেশকরণ করা।

>> উৎসে ভ্যাট কর্তনের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী কর্তৃক হ্রাস সংক্রান্ত সমন্বয় গ্রহণের সময়সীমা ২ কর মেয়াদ হতে বৃদ্ধি করে ৪ কর মেয়াদ করা।

>> ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্য বা সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপনের শর্ত লংঘন করলে অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের পরিবর্তে শুধু জরিমানা আরোপ করা।

বাজেটে নতুন করে কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট আরোপের পাশাপাশি এর আওতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও এসেছে তার প্রস্তাবে।

কেন্দ্রীয়ভাবে ভ্যাট নিবন্ধনেও কিছুটা ছাড় দেওয়ার ঘোষণা এসেছে মুস্তাফা কামালের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “ভ্যাট আইনে বর্তমানে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে একাধিক উৎপাদনস্থল থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ব্যবসায়িক বাস্তবতা বিবেচনা করে দুই বা ততোধিক উৎপাদনস্থলের পরিবর্তে এক বা একাধিক উৎপাদনস্থলের ক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজড অটোমেটেড পদ্ধতিতে হিসাবরক্ষণের শর্তে কেন্দ্রীয় নিবন্ধন গ্রহণ করার বিধান সন্নিবেশের প্রস্তাব করছি।”

পদ্ধতিগত জটিলতা কমাতে ভ্যাটের বিধিমালার আওতায় বেশ কিছু ফরমে সংশোধনী আনার প্রস্তাবও করেন তিনি।