গম রপ্তানি: ভারত কতদিন বন্ধ রাখবে বুঝতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা

ইউক্রেইন যুদ্ধের পর বাংলাদেশের গম আমদানির প্রধান উৎস হয়ে ওঠা ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা দীর্ঘায়িত হবে তা নিয়েই বেশি ভাবছেন ব্যবসায়ীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2022, 06:27 PM
Updated : 15 May 2022, 06:27 PM

প্রতিবেশী দেশটি থেকে গম পেতে দেরি হলে এ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা নিয়ে ভুগতে হতে পারে বলে শঙ্কার কথাও বলেছেন কেউ কেউ; কেননা সবশেষ দুই মাসে ভারত থেকেই এসেছে বেশির ভাগ গম।

যুদ্ধের পর রাশিয়া ও ইউক্রেইন থেকে গম আমদানি বন্ধ হলে বেসরকারি আমদানির পুরোটাই ভারত নির্ভর হয়ে পড়ে।

এর মধ্যেই শনিবার আকস্মিকভাবে দেশটির গম রপ্তানি নিষিদ্ধের সংবাদ এলে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বাংলাদেশের গম আমদানিকারক এবং আটা-ময়দাসহ অন্যান্য পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে। দাবদাহে উৎপাদন হ্রাস ও মূল্য বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে শনিবার থেকেই ওই সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা জানিয়েছে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

তবে আগের খোলা ঋণপত্র বা এলসির বিপরীতে গম পাওয়ায় সুযোগ থাকায় আরও কিছু দিন সরবরাহ লাইনে অসুবিধা হবে না বলে মনে করছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়েক লাখ টন আমদানির এলসি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

আমদানিকারকদের মতে, ভারতে গমের মৌসুম শুরুর এ সময়ে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত অনেকটা সময়জুড়ে বহাল থাকলে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে যোগান হুমকিতে পড়বে। তখন গমের চাহিদা পূরণে নতুন বাজার খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

যদিও এ নিষেধাজ্ঞা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

রোববার সিলেট সদর খাদ্যগুদাম পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভারত সরকারিভাবে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। বেসরকারিভাবে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে তারা রপ্তানি বন্ধ করলেও তাতে বাংলাদেশের উপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।

তিনি জানান, ইউক্রেইন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সম্প্রতি ভারত থেকে তিন লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। পরে যা দরকার হবে তাও ভারত থেকে আমদানি করার কথা বলেন তিনি।

রাশিয়া ও ইউক্রেইন থেকে গত দুই মাস ধরে কোনো গম আসছে না জানিয়ে দেশের বাজারে গম ও আটার অন্যতম সরবরাহকারী টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারত কতদিন ধরে রপ্তানি বন্ধ রাখে সেটাই দেখার বিষয়। অল্প সময়ের জন্য বন্ধ করলে তেমন সমস্যা হবে না। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করলে অবশ্যই চিন্তার বিষয়।

“ভারত লম্বা সময়ের জন্য গম রপ্তানি বন্ধ রাখলে সেটা বাংলাদেশের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। ভারতে এখন মাত্রই নতুন মৌসুমের গম বাজারে এসেছে। এই নিষেধাজ্ঞা যদি এক বছরের জন্য হয় তাহলে অবস্থা ভয়াবহ হবে।”

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নতুন বিকল্প দেশের সন্ধানে যেতে হবে মন্তব্য করে তিনি বিকল্প বাজার হিসেবে বুলগেরিয়া ও নেপালের কথা বলেন।

এছাড়া কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানির সুযোগ আগের মতই থাকছে বলে জানান তিনি।

তবে এ দুই দেশ থেকে মূলত উচ্চমূল্যের গম আমদানি করা হয়, যা মূলত ময়দা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১৩ মে পর্যন্ত বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে ২৯ লাখ ৬৬ হাজার টন গম। আর সরকারিভাবে এসেছে ৪ লাখ ৪০ হাজার টন গম।

অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে বাংলাদেশের মোট আমদানির মধ্যে ভারত থেকে ২৪ শতাংশ, কানাডা থেকে ২৩ শতাংশ, রাশিয়া থেকে ২১ শতাংশ এবং ইউক্রেইন থেকে ১৭ শতাংশ গম আনা হয়েছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক রায়হানুল কবীর রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে সাত লাখ টন গাম আমদানির লক্ষ্যমাত্রা তারা ঠিক করেছিলেন। এ পরিকল্পনার সব গমই কেনা হয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ লাখ গম দেশের অভ্যন্তরে চলে এসেছে। বাকি গম এলসি পর্যায়ে ও সমুদ্র পথে আছে।

সরকারি গবেষণা সংস্থা বিবিএসের হিসাবে, বর্তমানে দেশে গমের মোট চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ থেকে ৭০ লাখের মধ্যে যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশে মোট ১০ লাখ টন উৎপাদন হয়েছিল। এর আগের বছরের উৎপাদনও প্রায় সমপরিমাণ।

বিশাল এ ঘাটতি পূরণে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন ও বেসরকারিভাবে ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টন গম আমদানির তথ্য দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

বাজার চড়ছে আটা ময়দার

এদিকে যুদ্ধের আগেই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ায় তৈরি হওয়া অস্থিরতায় চলতি ২০২২ সালের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে গমের দাম। এর প্রভাবে দেশেও আটা ও ময়দার দাম বাড়তে শুরু করে।

পাশাপাশি আটা ও ময়দা দিয়ে তৈরি বিস্কুট, নুডুলস, সেমাইসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তে শুরু করে।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, বাজারে এখন খোলা আটা প্রতিকেজি ৩৮ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত নভেম্বরে ছিল ৩৩ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। প্যাকেট আটার দাম এখন ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা, যা গত নভেম্বরে ছিল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা। এক্ষেত্রেও দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

আর খোলা ময়দার দাম এখন ৫৬ থেকে ৬০ টাকা, যা গত নভেম্বরে ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। একইভাবে প্যাকেট ময়দার দামও ২৫ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে চলতি মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে এক লাখ ২৪ হাজার টন গম আমদানির এলসি মীমাংসা হয়েছে; যাতে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। এক্ষেত্রে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা হিসাব করলে প্রতিকেজি গমের আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৩২ টাকা।

আরও পড়ুন: