‘অস্থিরতা’ কাটেনি ভোজ্য তেলের বাজারে, পাইকারিতে কমছে দাম

ঈদের আগে ও পরে বাজারে সয়াবিন তেলের আকালের মধ্যে এক লাফে লিটারে দাম ৪০ টাকা বাড়ানোর সপ্তাহ খানেক পরও সরবরাহ লাইনে ‘অস্থিরতা’ রয়ে গেছে; যদিও কিছু বাজারে চাইলেই এখন মিলছে ভোজ্য তেল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2022, 06:30 PM
Updated : 13 May 2022, 06:54 PM

আর দেশজুড়ে হাজার হাজার লিটার আগের মজুদ করা তেল আটকের হিড়িকের মধ্যে নতুন দর সাধারণের ‘নাগালের বাইরে’ যাওয়ায় ভোক্তা চাহিদা কিছুটা কমায় সতর্ক খুচরা বিক্রেতারা। আগের মত সয়াবিন ও পাম তেল সংগ্রহের বদলে তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কৌশল নিতে দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে।

এদিকে চাহিদায় ভাটা পড়ায় পাইকারি ও খুচরায় খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামেও পতন ঘটছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমতে থাকায় মিল পর্যায়েও কমেছে পাম তেলের দাম।

শুক্রবার রাজধানীর একাধিক পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে তেল থাকা-না থাকা, চাহিদা কমে যাওয়া এবং দামের ওঠানামার ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে; যাতে ভোজ্য তেলের বাজারের ‘অস্থিরতা কাটেনি’ বলেই মনে করছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।

তেল আসছে বাজারে

রোজার ঈদের ছুটি শেষে গত ৫ মে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে অন্তত ৪০ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করে মিল মালিকরা; যাতে সরকারেরও সায় মেলে।

রাজধানীর এ দোকানে অন্য ভোজ্য তেল থাকলেও সয়াবিন ছিল না।

দাম বাড়বে বলে গুঞ্জন থাকায় এর ১৫ দিন আগে থেকে বাজারে ধীরে ধীরে ভোজ্য তেলের সংকট দেখা দিতে শুরু করে। ঈদের দুই তিন আগে ও পরে দেশজুড়েই খুচরা দোকান থেকে তেল নাই হয়ে যায়।

নতুন দর অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য ১৯৮ টাকা করা হয়। খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং পাম তেল ১৭২ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়।

নতুন দর নির্ধারণের পর গত সপ্তাহের শুরুতে ব্যাংক খোলার পর বাজারে নতুন তেল আসতে শুরু করে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বেশি দামের আশায় মজুদ করা তেলের বড় অংশও সরকারি তদারক সংস্থার অভিযানের ধরা পড়লে তা ভোক্তা পর্যায়ে আসতে শুরু করে।

গত কয়েক দিনে দেশজুড়েই প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার (কোনোদিন তা লাখও ছাড়িয়েছে) মজুদ ভোজ্য তেল আটক করে বাজারে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে বেশি লাভের আশায় হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া তেলের দেখা আবার পেতে শুরু করেছেন ক্রেতারা।

তবে মিল থেকে দেওয়া শুরু হলেও তেলের সরবরাহ লাইন পুরোদমে স্বাভাবিক হয়নি। টিকে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আতহার তসলিমের কথাতেও সেই চিত্র কিছুটা মিলল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নতুন দামে তেল সরবরাহ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত দেশের সর্বত্র পৌঁছানো যায়নি। তবে প্রধান প্রধান স্পটগুলোতে তেল পৌঁছে গেছে।“

কিছু এলাকায় তেল পর্যাপ্ত থাকলেও ক্রেতা কম; আবার কিছু এলাকায় তেল পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে তসলিম বলেন, “এটা হতে পারে। কিছু এলাকায় হয়ত অনেকেই পাইকারিভাবে তেল সংগ্রহ করেছে। অনেক এলাকায় হয়ত পাইকারি ব্যবসায়ীরা কোনো কারণে তেল সংগ্রহ করতে পারেনি।“

খুচরা বিক্রির হালচাল

বেশ কয়েকদিন দোকানে সয়াবিন না পাওয়ায় অনেকই বিকল্প ভোজ্য তেল সংগ্রহ করে কাজ চালিয়েছেন। আর যারা সংকটের আগেই ঈদ বাজারের অংশ হিসেবে বেশি পরিমাণে তেল কিনেছেন তারা নতুন করে কিনছেন না। এতে চাহিদা কিছু কমায় খুচরা দোকানিরা নতুন করে তেল তোলার আগে দ্বিতীয়বার ভাবছেন। 

মিরপুর ১ নম্বরের মুদি দোকান মানিকগঞ্জ ভ্যারাইটির পরিচালক সজিব জানান, ঈদের চার দিন আগ থেকেই তার দোকানে তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঈদের পরেও পাননি। দুদিন ধরে খোলা সয়াবিন ও পাম তেল আসতে শুরু করলেও বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ এখনও সীমিত।

মঈনুল স্টোরের ফারুক হোসেন জানান, ঈদের পর শুক্রবার দোকান খুললেও মঙ্গলবার পর্যন্ত তেল পাননি।

“এরপর থেকে তীর কোম্পানি তেল দেওয়া শুরু করে। তবে এখন আবার চাহিদা কমে গেছে। দৈনিক ৫ কার্টন তেল বিক্রি হত। গতকালও (বৃহস্পতিবার) একই পরিমাণ তেল পেলাম। অথচ আজও অর্ধেক রয়ে গেছে।

“মনে হয় মানুষজন প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেল কিনে নিয়েছে; তাই এখন চাহিদা কমে গেছে,” যোগ করেন তিনি।

বাজারে দামের উঠানামার কারণে ঝামেলা এড়াতেও খোলা পাম ও সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ রাখার কথাও জানান ফারুক।

“খোলা তেল এখন বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। সরকার যেই দামে বিক্রি করতে বলে সেই দামে তেল পাওয়া যায় না। পরে আবার ভোক্তা অধিকার এসে জরিমানা করে। আপাতত খোলা তেল বিক্রি করব না। বাজার যখন স্বাভাবিক হবে; অন্ততঃ আরও এক মাস পর পরিস্থিতি বুঝে বিক্রি শুরু করব,” বলেন তিনি।

পাশের হক ভ্যারাইটির স্বত্ত্বাধিকারী সোহেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সঙ্কটের সময় অনেকেই অ্যাডভান্সড পারচেজ করে ফেলেছে। তাই এখন বাজারে তেল আসার পর বিক্রি আগের মত হচ্ছে না। অর্ধেকের বেশি চাহিদা কমে গেছে। আগে যেখানে ১০০ লিটার তেল বিক্রি করতাম এখন সেখানে ৫০ লিটারও বিক্রি হচ্ছে না।

“অলরেডি আমি কেনা কমিয়ে দিয়েছি। আগে ডেইলি ৫ ড্রাম করে তেল কিনতাম। আজকে থেকে এক ড্রাম করে কিনছি। কারণ হচ্ছে- তেল তো বিক্রি করা যাচ্ছে না। পাইকারে বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমে যাওয়ায় গত পরশু দিন যে ৫ ড্রাম তেল কিনেছিলাম সেখানে প্রতি ড্রামে আমাকে ১৫০০ টাকা করে লোকসান দিতে হয়েছে। পাশের দোকানে কম দামে তেল পেলে তো আমার কাছ থেকে বেশি দামে তেল নেবে না।“

গত বুধবার ৩৬ হাজার ৭০০ টাকা করে প্রতি ড্রাম সয়াবিন তেল কেনার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “একটু আগে এক ড্রাম কিনলাম ৩৬ হাজার ২০০ টাকায়। মিরপুর বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির এসও ডিলার রয়েছে। বাজারে যেহেতু বিক্রি কমে গেছে উনারাও তাই দাম কমিয়ে দিয়ে বিক্রি শুরু করেছেন।”

মীরপুর জনতা হাউজিংয়ের মহল্লার মুদি দোকানি আলমগীর হোসেন বলেন, ঈদের আগে পরে ১৫ দিন আমি তেল বিক্রি করতে পারিনি। তীর, পুষ্টি, রূপচাদার প্রতিনিধিরা কেউ তেল দিতে পারেনি। ঈদের পরে একদিন ৫ লিটারের চারটি বোতল দিয়েছিল। ওই দিনই ওগুলো শেষ হয়ে গেল। কালকে ৫ লিটারের এক কার্টন (৪ বোতল) ও ১ লিটারের এক কার্টন তেল দিয়েছে।

“এই কয়দিনে কাস্টমার তেলের জন্য অনেক ঘুর ঘুর করছে। এখন তেল হাতে পাইছি। পাওয়ার পর আর তো কাস্টমার আসে না। দুই দিনে একটা ৫ লিটারের বোতল ও একটা ১ লিটারের বোতল বিক্রি করেছি। আমি এখন বাধ্য হয়ে তেল শেলফের ওপর ডিসপ্লে করে রেখেছি। প্রতিটি বোতলে লিটারে এমআরপি থেকে ৪ টাকা করে কম দামে তেল দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। অর্থাৎ লিটারে ৪ টাকা করে লাভের সুযোগ দিচ্ছে।“

মিরপুরের পশ্চিম অঞ্চলে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসলেও আরেকটু পূর্ব দিকে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় বড়বাগ কাঁচাবাজার এলাকায় এসে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। অধিকাংশ মুদি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দেখা নেই। বরং রয়েছে কিছু রাইস ব্রান ও সূর্যমুখী তেলের মজুদ।

বড়বাগে সিরাজ স্টোরের বোরহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঈদের পর সিটি গ্রুপের পক্ষ থেকে ১০ কার্টন তেল দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ওইদিনই শেষ হয়ে গেছে। এরপর আর কোনো তেল আসেনি। এখন তাদের কাছে রাইস ব্রান ও সূর্যমুখী তেল রয়েছে।

প্রতিলিটার ৩২০ টাকা করে বিক্রি করতে হয় সূর্যমুখী তেল। অবশ্য রাইসব্রানের দাম সেই তুলনায় কম; ৫ লিটার ৯৬৫ টাকা, জানান তিনি।

এই বাজারে আব্বাস জেনারেল স্টোরের দোকানি জানান, তার দোকানে কোনো বোতলজাত তেল নেই। তাই বাধ্য হয়ে খোলা পাম ও সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন তিনি।

দাম কমছে পাম তেলের

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঈদের পর সরকারের নির্ধারিত দরে সরবরাহ শুরু হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা পর্যাপ্ত নয়।

সরবরাহ স্বাভাবিক করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “সাপ্লাই আরও বাড়াতে হবে। হয়ত এখন দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষ তেল কম কিনবে। কিন্তু তেল ছাড়া তো আর চলা যাবে না।“

সয়াবিনের দাম স্থিতিশীল থাকলেও পাম তেলের দাম কমছে বলে জানান তিনি।

“পাম তেলের বাজার এখন একটু নিম্নমুখী। পাম তেল সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে মণপ্রতি ৪০০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল খুচরায় ১৮০ টাকা দাম বেঁধে দেওয়া হলেও মিল থেকে লিটার ১৭৭ টাকা করে ছাড়ছে। এতে পাইকারি বিক্রেতাদের লাভের মার্জিন থাকবে না। সরকার খুচরায় দাম ঠিক করলেও মিল গেইটে দাম ঠিক করেনি,” বলেন হাশেম।

সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে লিটার ২০০ টাকার কাছাকাছি গেছে ঈদের পর। দোকানিরা আগে কেনা তেল বাড়তি দামে বিক্রি করছে কি না, তা দেখতে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

মিল থেকে তেল কিনে পাইকারি পর্যায়ে বিপণনকারী ব্যবসায়ী বিপুল চন্দ্র মিস্ত্রী বলেন, ঈদের পর সাতটা এসও (সাপ্লাই অর্ডার) কিনেছিলাম। এস আলমের মিল থেকে দিনে দিনে সরবরাহ করা হলেও গ্লোব ভেজিটেবল অয়েল মিল থেকে পাঁচ দিন পর সবরাহ দেওয়া হয়েছে।

“অন্যদিকে দাম বাড়ার কারণে চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। আমি প্রতিদিন ১০০ ড্রাম তেল বিক্রি করতে পারতাম। এখন ৬০ ড্রাম বিক্রি করাও অনেক কষ্ট। পাম তেল সরকারি রেট হচ্ছে প্রতি ড্রাম ৩৫ হাজার ৮৮ টাকা। সেখানে আমরা এখন ৩৩ হাজার ৫০০ টাকায়ও বিক্রি করতে পাচ্ছি না।“

বিভিন্ন মিলে যোগাযোগ করার পর তিনি জেনেছেন, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে লিটারে ৩ টাকা কমে পাম তেল ছাড়তে চাচ্ছে মিলগুলো।

টিকে গ্রুপের পরিচালক তসলিমও ঈদের পর পাম তেলের বাজার কিছুটা কমে এসেছে জানিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে। তাই লোকাল বাজারেও কমছে। ব্যবসাটা ব্যবসার গতিতে চলবে। সরকার যত টাকাই দাম বেঁধে দিক না কেন, কোনো ব্যবসায়ী যখন দেখবে দাম পড়ে যাচ্ছে, তারা দাম কমিয়ে দ্রুত পণ্য সরবরাহ লাইনে দিয়ে দেবে।

“সরকারি হিসাবে প্রতিমণ পাম তেলের দাম আসে ৬৮০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০০ টাকা থেকে ৬৬৫০ টাকার মধ্যে।”