দাম বাড়ানো নিয়ে পাল্টাপাল্টি: ভোজ্যতেল কারখানায় ‘অধিকতর তদন্তে’ যাবে মন্ত্রণালয়

ভোজ্যতেল কারখানাগুলোর প্রবেশমুখে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও সেখানে চাঁদাবাজি এবং সরবরাহ আদেশ (এসও) কয়েকবার হাতবদলই খুচরা বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণ বলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2022, 05:46 PM
Updated : 9 March 2022, 05:46 PM

বুধবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কার্যালয়ে ভোজ্যতেল মিল মালিক এবং সরবরাহ পর্যায়ের সব স্তরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে দাম বাড়ার এসব তথ্য উঠে আসে।

এমন প্রেক্ষাপটে কারখানা পর্যায়ে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আগামী কয়েক দিনে ‘কারখানায় অধিকতর তদন্ত’ চালানো হবে বলে বৈঠক শেষে জানান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান।

বৈঠকে অভিযোগ করা হয়, ভোজ্যতেলের মিলগুলোতে সরবরাহ আদেশ (এসও) দেওয়ার পর মিল গেইটে ট্রাক নিয়ে সাত থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয় ডিলার বা তাদের প্রতিনিধিদের। ফলে ট্রাক ভাড়া বাবদ প্রতিদিন গুণতে হয় কয়েক হাজার টাকার বিলম্ব ফি।

আবার মিলগুলোতে এসও বুকিং দেওয়ার পর নিজেরা পণ্য বুঝে না নিয়ে তা অন্যের কাছে লিটারে অন্তত ১১ টাকা লাভে ‘বেআইনিভাবে’ বিক্রি করে দেন ডিলাররা। এ প্রক্রিয়ায় একাধিকবারও এসও হাতবদল করেন ভোজ্যতেলের সরবরাহ পর্যায়ে অর্থলগ্নিকারী অনেকে।

বৈঠকে জানানো হয়, ডিলারদের কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা অস্বাভাবিক দামে তেল কিনলেও এ লেনদেনে থাকে না কোনো প্রমাণ বা পাকা রশিদ।

আর মিলগুলোতে পণ্য বুকিং দিয়ে তা ১৫ দিনের মধ্যে বুঝে নেওয়ার কথা থাকলেও অনেক অর্থলগ্নিকারী ব্যবসায়ী ভালো দামের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। এ জন্য তারা পণ্য বুঝে নেন না।

এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদা না দিলে তেল বুঝে নেওয়ার জন্য কারখানার অভ্যন্তরে ঢুকতে পারে না ট্রাকগুলো।

বিশ্ব বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং ইউক্রেইন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে সম্প্রতি ‘সরবরাহ সঙ্কটের মিথ্যা খবর ছড়িয়ে’ ব্যবসায়ীরা সয়াবিন ও পামতেলের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার ও বুধবার ভোজ্যতেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তর।

খুচরায় এখন সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ভোক্তার কাছ থেকে লিটারে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি নেওয়া হচ্ছে। বেশ দাম দিয়েও কোথাও কোথাও মিলছে না তেল।

তবে আমদানি ও মজুদের হিসাব বিশ্লেষণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, শুধু কারখানা পর্যায়ে যে মজুদ রয়েছে তা দিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময়ের জোগান দেওয়া যাবে।

বুধবার ভোজ্যতেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সব স্তরের ব্যবসায়ীদের মুখোমুখী বসিয়ে ধাপে ধাপে এভাবে দাম বাড়ানোর এসব বিষয়ে জানতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

অনিয়মের কিছু বিষয় ব্যবসায়ীরা স্বীকার করলেও মিল মালিকরা তা স্বীকার করেননি।

এরপর ‘কারখানায় অধিকতর তদন্ত চালানো হবে’ বলে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব সফিকুজ্জামান বলেন, মিল থেকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার- এখন সরবরাহ অর্ডার-এসও বলা হচ্ছে) লেটারের মাধ্যমে পণ্য কিনে। এরপর সেই পণ্য বুঝে না নিয়েই আরেকজন ক্রেতার কাছে লিটারে ১১ টাকা বেশি দরে বিক্রি করে দিয়েছেন একজন ডিলার।

ফাইল ছবি

“এতে করে আমার যা বোঝার সেটা বোঝা হয়ে গেছে।“

মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। সেই হিসাবে প্রতিমাসে এক লাখ ৩০ হাজার টন তেলের প্রয়োজন হয়। রোজার মাসে চাহিদা বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ টন হয়ে থাকে। আর দেশে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সামগ্রিক সক্ষমতা বার্ষিক ৫০ লাখ টন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যের বরাত দিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, বাজারে দৈনিক তেলের চাহিদা পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টন। সেখানে মিলগুলোতে দৈনিক ১৫ হাজার টন করে পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে। মিল পর্যায়ে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত অবস্থায় দুই লাখ টনেরও বেশি তেল মজুদ রয়েছে। পাইপলাইনে, শিপমেন্ট অবস্থায় এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি স্থানে জাহাজে রয়েছে দুই লাখ ৩২ হাজার টন। এগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে চলে আসবে।

“এখানে কৃত্রিম যে সংকট সেটা কিন্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। আজকের বৈঠক থেকেও কিন্তু সেই সংকট ডিফাইন করতে পারি নাই, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য হেতু বের করা যায়নি।“

বৈঠকে সিটি, মেঘনা, টিকে ও বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা গত তিন মাসে নিজেদের পণ্য সরবরাহের তথ্য উপস্থাপন করেন। মিল পর্যায়ে মজুদ ও সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই বলেও দাবি করেন তারা।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন বাবুল বলেন, মিলগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হোক যে, তারা গত একমাসে যেসব পণ্য বিক্রি করেছে সেগুলো কতটাকা দরে বিক্রি করেছে।

“ভবিষ্যতে তারা কত টাকা দরে বিক্রি করতে চায় সেটাও তাদের কাছে জানতে চাওয়া হোক। আমরা লিটারে এক টাকার বেশি লাভ করতে চাই না। এমনকি রোজার মাসে আমরা কোনো লাভই করতে চাই না।“

সানভীর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী দিপু বলেন, সিটি গ্রুপ এখানে দাবি করছে তারা সঠিকভাবে মালের ডেলিভারি দিচ্ছে। কিন্তু তাদের ওখানে একটা গাড়ি গেলে ৮/১০ দিন বসে থাকতে হয়। এমনকি ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

“সর্বশেষ আমার যেই গাড়িটি গেছে সেটি ১০ দিন বসে থেকে ওখান থেকে গেছে টিকে গ্রুপের মিলে। সেখানে সাত দিন বসে থাকার পর পণ্য বুঝে পায়। সেখান থেকে গেছে গ্লোবে, সেখানে সাত দিন ধরে গাড়িটা বসা, কিন্তু মাল পায়নি। এভাবে প্রতিটি গ্রুপ এমন করে।“

তার অভিযোগ একটা গাড়ি নিয়ে কোন মিলে ঢুকতে সয়াবিন তেলের জন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়া লাগে।

“এলাকায় স্থনীয়দের যোগসাজসে একটা দালাল গ্রুপ আছে। তাদেরকে টাকাটা দিতে হয়। গাড়ি নিয়ে ওরা সিরিয়াল দেওয়ায়,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, একটা গাড়ি একদিন বসে থাকলে তিন হাজার টাকা ডেমারেজ দিতে হয়।

“দেশের মিল মালিক যারা আছেন, তাদের এটা তদন্ত করা উচিত যে, আসলে এখানে কী হচ্ছে।“

টিকে গ্রুপের পরিচালক শাফিউল তসলিম বলেন, ১৫ দিন আগের ডিও আসে। আবার ২০ দিন আগের পুরোনো ডিও নিয়েও উনারা আসেন। তাহলে আমরা কাকে আগে দেব?

“গতকালও (মঙ্গলবার) আমি ২৫০ ট্রাক তেল ডেলিভারি দিয়েছি। এভাবে গত তিনমাস ধরে দিয়ে আসতেছি। তেলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ ধরে। তাহলে আমাদের দোষটা কোথায়?” সরকার নির্ধারিত মূল্যে নিয়মিত সরবরাহ করার দাবি করে তিনি বলেন, গত তিনমাসে আমি কী পরিমাণ তেল সরবরাহ করেছি সেই তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। আপানারা মিলিয়ে দেখেন। কখনও তেলের সরবরাহ কমে নাই।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা জানান, ভোক্তা অধিকার থেকে সরবরাহ ও বিক্রির তথ্য চাওয়ার পর ৭ মার্চ যে তথ্য জমা দিয়েছি, সেখানে গত তিন মাসে এক লাখ ৫৬ হাজার ৫৬৭ টন; প্রতিমাসে গড়ে ৫২ হাজার ২০০ টন এবং প্রতিদিন গড়ে ২১০০ টন সরবরাহ করা হয়েছে।

এসব পণ্য সরকারি মূল্যে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার স্টেটমেন্টে যেসব ব্যবসায়ীর নাম আছে তাদের একটা একটা করে ধরে জিজ্ঞেস করা হোক যে, আমার স্টেটমেন্ট সঠিক কিনা?”

ঢাকার দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে শনিবার দুপুরে মেসার্স আবুল খায়ের ট্রেডার্সে অভিযান চালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নির্বাহী হাকিম। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এসব শুনে অতিরিক্ত সচিব সফিকুজ্জামান বলেন, “আপনার তথ্য এবং ডিলারদের তথ্যের মধ্যেই তো বড় গরমিল। বাজার থেকে বড় অংকের একটা টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই টাকাটা কে নিল, কোথায় নিল সেটা তো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

“আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। কিন্তু পেছনেও তাকাতে হবে যে, টাকাটা কে নিয়েছে?”

মিল পর্যায়ে যাবে প্রতিনিধিদল

বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, আজ থেকে যতগুলো এসও (ডিও) যাবে সেগুলোতে প্রাইস লেখা থাকতে হবে। গতকালকেও (মঙ্গলবার) যদি কোনো এসও বুকিং দেওয়া হয় সেটা ২৪ মার্চের মধ্যে ডেলিভারি দিতে হবে।

“তেল দেশের বাইরে যায় কিনা এ বিষয়েও তদন্ত শুরু করা হবে। ট্রাক প্রতি যে ৫০ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে সেটা নিয়েও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো।“

তিনি বলেন, “আমাদের একটি দল মিলগুলোতে গিয়ে বসবে। ডিও লেটার বুকিং দেওয়ার পরও দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেই বিয়ষটা যাচাই করে দেখব।“

আর শুক্রবার থেকে বাজার অভিযানে ‘পাকা রশিদের’ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। এটি ছাড়া মালামাল দেখতে চাই না, যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: