টিসিবির প্রতিবেদন বলছে, খুচরায় প্রতি কেজি প্যাকেট আটা ও ময়দার দাম এখন যথাক্রমে ৪৫ ও ৫৮ টাকা। এক মাস আগে আটা অপরিবর্তিত থাকলেও ময়দার দাম বেড়ে হয় কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা।
আর এক বছর আগে এ দুই নিত্যপণ্যের দাম ছিল যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৫ টাকা। সেই হিসাবে বছরের ব্যবধানে প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ; আর ময়দার বেড়েছে ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্য গম আমদানিকারক ও আটা-ময়দা প্রস্তুতকারক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিকরা বলছেন, ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর গমের বাজার পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ময়দার দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা তাদের। এতে সমান্তরালভাবে বাড়বে আটার দামও।
ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকমাস আগে বিশ্ববাজারে গমের দাম ছিল প্রতি টন ৩২০ ডলার। ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দাম এখন ৫২০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ৫০০ ডলারে (প্রতি টন) কেনা গম দেশে পৌঁছাবে।”
তখন আটা-ময়দার বর্তমান দর বর্ধিত আমদানি দরের সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ানোর বিকল্প থাকবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“তখন আর আটা-ময়দার বাজার থাকবে না। মানুষ আটা-ময়দা থেকে মুখ ফিরিয়ে ভাতের ওপর নির্ভরশীল হবে। অর্থাৎ এত চড়া মূল্যে আটা-ময়দার বিপণন করা যাবে না,” যোগ করেন তিনি।
ইউক্রেইনে যুদ্ধের কয়েক মাস আগেই বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করেছিল গমের দাম। শীর্ষস্থানীয় গম রপ্তানিকারক দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের দামামা ছড়িয়ে পড়ার পর গমের বাজার গত তিন মাসে প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করছেন মিল মালিকরা।
মূল্য বাড়ার প্রভাবে ইতোমধ্যে গম আমদানি ধীর হয়ে যাচ্ছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে। গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশি জোগান ছাড়াও বেসরকারিভাবে প্রায় ৪৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ টন।
গমের আমদানি খরচ বাড়ার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে। এতে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১১৯ কোটি ১০ লাখ ডলারের গম আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি।
গত ১ মার্চ সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্ববাজারে গমের মূল্য ৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে যত গম উৎপাদিত হয়, তার ১৪ শতাংশই হয় ইউক্রেইন ও রাশিয়ায়। রপ্তানিবাজারের ২৯ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে দেশ দুটি। ইউক্রেইন অঞ্চল থেকে মিশর, তুরস্ক ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে গম যায়।
মজুদ নিয়ে নির্ভার সরকার
বিশ্ববাজার পরিস্থিতি দিনে দিনে নাজুক হতে থাকলেও সরকারি রেশনিংসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়ের জন্য গমের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর।
সরকারি গুদামগুলো ধারণ ক্ষমতার সমান ধান-চাল ও গমের মজুদে পরিপূর্ণ এবং পাশাপাশি গমের যে মজুদ রয়েছে তা দিয়ে আগামী ছয় মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাখাওয়াত হোসেন।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরকারের গম সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টন কেনার পরিকল্পনা থাকলেও সেটা বাড়িয়ে ছয় লাখ টন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে চার লাখ টন গম চলে এসেছে, আরও ৫০ হাজার টন আসার পথে। সংগ্রহ লক্ষ্য অনুযায়ী হচ্ছে।”
বাকি এক লাখ টন অবস্থা বুঝে কেনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের যে গুদাম রয়েছে সেখানে এ মুহূর্তে জায়গা নেই। ২০ লাখ ৫০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার মধ্যে ২০ লাখ টন শস্য মজুদ করা হয়েছে।
“গমের ক্ষেত্রে গোডাউনে তিন মাসের মজুদ থাকলেই যথেষ্ট মনে করা হয়। সেখানে আমাদের পাঁচ বা ছয় মাসের মজুদ আছে। বর্তমানে মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনকের চেয়েও অনেক ভালো। তবুও বিশ্ববাজারে যদি খাদ্যশস্যের দাম বাড়ে, এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে এটাই স্বাভাবিক,” বলেন শাখাওয়াত।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১৭ দশমিক ৩৯ লাখ টন এবং গম দুই দশমিক ২৪ লাখ টন। বাকি ৪৫ হাজার কেজি ধান।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছিল। আর বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টন গম। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার টন গম। আর সরকারিভাবে এসেছে ৪ লাখ ৪ হাজার টন গম।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকারি ক্রয় কমিটি সিঙ্গাপুরের এগ্রোকর্পো ইন্টারন্যাশনাল থেকে ৫০ হাজার টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এজন্য প্রতি টন ৩৯০ দশমিক ৯২ ডলার হিসাবে মোট খরচ হচ্ছে এক কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৬৮ কোটি ৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতিকেজি গমের দাম পড়ছে ৩৩ টাকা ৬১ পয়সা।
আরও পড়ুন