তবু বাণিজ্য মেলা চলবে

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, চার মাসের মাথায় ফের স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার; তবে বাণিজ্য মেলা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন আয়োজকরা।  

ফয়সাল আতিকও কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2022, 07:38 PM
Updated : 21 Jan 2022, 07:38 PM

জানতে চাইলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সচিব ও মেলার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাণিজ্য মেলা চলবে। স্বাস্থ্যবিধিতে যা বলা আছে তাতে মেলা বন্ধ করার কোনো কারণ নেই।“

তবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ পরিস্থিতিতে মেলা চালানোর পক্ষে নন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয়, টোটালি বাণিজ্য মেলাটা বন্ধ করে দিতে পারলে ভালো হত, অনেস্টলি স্পিকিং।”

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কোভিড মহামারীর কারণে এক বছর ছেদ পড়ার পর পূর্বাচলের নতুন ঠিকানায় ১ জানুয়ারি শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ঘোষণা অনুযায়ী পুরো জানুয়ারি মাস এ মেলা চলার কথা। 

শেরে বাংলা নগরের পুরনো ঠিকানা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে শুরুতে মেলা তেমন জমেনি। তবে কয়েকদিনের মধ্যে ভীড়-ভাট্টা বাড়তে শুরু করে, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনাও সামনে আসছিল।

এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবের পর সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করে ১০ জানুয়ারি, যা কার্যকর করা হয় ১৩ জানুয়ারি থেকে।

সেসময় মেলার পরিচালক বলেছিলেন, “মাস্ক ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। মেলার ভেতরেও মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে বিশেষ নজর রাখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।”

দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় শুক্রবার সকালে নতুন বিধিনিষেধের ঘোষণা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেখানে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একশ জনের বেশি মানুষের সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন, তাদের অবশ্যই টিকা সনদ অথবা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করা পিসিআরে কোভিড টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে হবে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কিন্তু ঢাকায় এখন মাসব্যাপী বাণিজ্যমেলা চলছে, বইমেলার প্রস্তুতি চলছে; ক্রিকেটের আসর বিপিএলও শুরু হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কী হবে?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যে কোনো জনসমাগমে যেতে হলে টিকা সনদ নিয়ে যেতে হবে। এটা সব জায়গায় প্রযোজ্য হবে।

“বই মেলা, স্টেডিয়াম, বাণিজ্যমেলাসহ সবখানেই এখন থেকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে।”

তার ভাষায়, স্টেডিয়ামের বিষয় যখন আসে, সেখানে তো আর একশ জনের বেশি লোক যাবে না, এমন বলা যায় না।

“খেলা তো স্টেডিয়ামে হয়। সেখানেও টিকা সনদ নিয়ে আর টেস্টের সনদ নিয়ে যেতে হবে। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।“

বাণিজ্য মেলায় দর্শনার্থীদের টিকেট বিক্রির দায়িত্বে থাকা মীর ব্রাদার্সের কর্মকর্তা তারেক মোশাররফ মুকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন বিধিনিষেধের কারণে মেলায় দর্শনার্থী গত শুক্রবারের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে।

“গত শুক্রবার ৫০ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছিল। আজকে সর্বমোট ৪০ হাজার দর্শনার্থী আসতে পারে বলে আমাদের ধারণা।”

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এই বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম হলে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে মেলা চালানো সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নে মেলার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, “আমরা মেলার শুরু থেকেই কঠোর স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের বিষয়ে লোক নিয়োগ করেছি।  নতুন স্বাস্থ্যবিধি জারি হওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এর মানে হচ্ছে মেলা চলবে। তবে নতুন সিদ্ধান্ত আসলে সেটা ভিন্ন কথা।”

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান ও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচ এম আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা কেউ ফোন ধরেননি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সোয়া ৪০ হাজারের বেশি পরীক্ষা করে ১১ হাজার ৪৩৪ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে; যা গত বছরের ৯ অগাস্টের পর সর্বোচ্চ।

নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারও বেড়ে ২৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়েছে, যা আগের দিন ২৬ শতাংশের ঘরে ছিল।

। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ অবস্থায় বাণিজ্য মেলা বন্ধ রাখাই ভালো হত। কিন্তু তা না করে বাণিজ্য মেলায় টিকা সনদ নিয়ে যাওয়ার একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

“এটা কিন্তু চ্যালেঞ্জিং। যদি করতে পারে, তাহলে তো ভাল। তবে পারবে কিনা সেটা একটি বিষয়।”

ড. শহীদুল্লাহ বলেন, “আমি টেলিভিশনে আজকে লক্ষ্য করলাম, বাণিজ্য মেলার কয়েকটি স্টলে কিছুটা হলেও মাস্ক ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ পরছে না। তাহলে বাণিজ্য মেলার যারা ব্যবস্থাপক, তারা বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক রাখছে না কেন, যাদের কাজ হবে মাস্ক পরাটা নিশ্চিত করা।”

মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে পারলে করোনাভাইরাসের বিস্তার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে করা যেত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এছাড়া অনেক বেশি মানুষের যেন সমাগম না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে মেলা কর্তৃপক্ষকে। এটা কিন্তু খুব কঠিন না। ৫০ বা ১০০ জনের স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ করলে এটা করা সম্ভব। যারা ক্রেতা তারা এবং বিক্রেতা তারা মাস্ক পরছে কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ঢাকা বাণিজ্য মেলায় একটি স্টলে দর্শনার্থীদের ভিড়।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, ‘সবকিছু’ বন্ধ করে দিলে ভালো হত, কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে সবকিছু বন্ধ করা যাচ্ছে না।

“যেগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না, সেগুলোতে যদি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা যায়- সেটার ওপর জোর দিতে হবে।”

সেজন্য বাণিজ্যমেলায় টিকা সনদ ছাড়া দর্শণার্থীদের ঢুকতে না দেওয়া এবং মাস্ক পরা নিশ্চিত করার কথা বলছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

বাণিজ্যমেলার সাথে অনেক মানুষের জীবিকা জড়িত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শুধু যাদের স্টল রয়েছে, তারা নয়। এর বাইরের অনেক মানুষ, এর সাথে জড়িত। এর সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টি জড়িত।

“যারা টিকা নেয়নি তাদের নিরুৎসাহিত করতে হবে ওখানে যেতে। যারা টিকা নিয়েছে, তাদের করোনাভাইরাস হবে না, তাও নয়। তবে তাদের ঝুঁকিটা কমবে। যেখানে ১০০ জনের সমাগম হবে, সেখানেও যারা টিকা নেয়নি, যেতে পারবে না।”