বিইআরসি ফিরিয়ে দেওয়ার পর ফের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো জানুয়ারির শুরুতে যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা ‘বিধি বহির্ভূত’ ছিল জানিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন- বিইআরসি।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2022, 06:59 PM
Updated : 20 Jan 2022, 07:50 PM

এখন নতুন করে আবার আবেদন করতে শুরু করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো, যদিও এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দৃশ্যমান কোনো কারণ দেখছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।  

কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কয়েকটা বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে আবেদন পেয়েছিলাম। বিইআরসি আইন ও প্রবিধান অনুযায়ী এগুলো পূর্ণাঙ্গ আবেদন নয় বিধায় আমরা তা গ্রহণ করিনি। নিয়ম অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রস্তাব পাঠাতে বলেছি। পরে দুই থেকে তিনটা কোম্পানি আবারও আবেদন পাঠিয়েছে।

“নতুন আবেদনে সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র দিতে হবে, ফি দিতে হবে, অডিট রিপোর্ট দিতে হবে। সর্বমোট ৮/১০টা ডকুমেন্ট দিতে হবে।”

গ্যাস খাতে সরকারি কোম্পানি রয়েছে সাতটি। এর ছয়টি বিতরণ কোম্পানি এবং একটি সঞ্চালন কোম্পানি।

সঞ্চালন কোম্পানির কাছ থেকে যে দামে গ্যাস পাওয়া যায়, এর সঙ্গে কোম্পানির পরিচালন ব্যয়সহ আরও কিছু আনুসঙ্গিক ব্যয় সমন্বয় করে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

এ অবস্থায় গ্যাসের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির আগেই কেন বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিইআরসির।

কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে গ্যাসের পাইকারি মূল্য বাড়ানোরও কোনো যৌক্তিকতা নেই। খুচরা মূল্য বৃদ্ধি তো অনেক দূরের কথা। তারপরেও বিতরণ কোম্পানিগুলো কেন মূল্য বৃদ্ধির এমন প্রস্তাব নিয়ে এল, তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা প্রাথমিকভাবে তাদের প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়েছি। দেখা যাক পরে কী হয়।”

গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের খুচরা মূল্য ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে কাছে পাঠিয়েছিল। তাতে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

একই হারে আবাসিকের প্রিপেইড মিটার, শিল্প, সিএনজি, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ গ্যাসের দামও বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল বিতরণ কোম্পানিগুলোর।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিইআরসির চেয়ারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাম কত বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করছিনা। তাদের প্রস্তাব কারিগরি কমিটি যাচাই করে দেখবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা সব কোম্পানির কাছ থেকে আবেদন পেলেই কেবল এ নিয়ে ভাবব।“

বিতরণ সংস্থা পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মান্নান পাটোয়ারি জানান, তারা শুরুতে একবার আবেদন করার পর তা ‘অপূর্ণাঙ্গ’ থাকায় আরেকটি আবেদন করেছেন। এবার ‘সব ধরনের কাগজপত্র ও তথ্য’ জমা দেওয়া হয়েছে।

কেন দাম বাড়াতে চান- জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সেটা আবেদনে আছে। আমি এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না।”

বিইআরসির একজন সদস্য বলেন, “গত দুই বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। সিস্টেমে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিজস্ব গ্যাস, যেটার দাম ওঠানামা করছে না। দ্বিতীয়ত ৬০০ মিলিয়ন গ্যাস আছে এলএনজি থেকে, এটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে দাম ওঠানামা করছে না। আগামী ১০ বছরেও দাম ওঠানামা করবে না।

“বাকি ১৫০ মিলিয়ন গ্যাসের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা ওঠানামা করতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৫০ মিলিয়নের দাম যদি ৫ টাকা করেও উঠানামা করে তাতে কী এমন আসে যায়? এর প্রভাব বাজারে কতটা পড়বে? আপনারাই অংকটা করে দেখেন।”

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩০ জুন গ্যাসের গড়মূল্য ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ায় বিইআরসি। তাতে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৩৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা হয়।

আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার জন্য মাসে ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকার পরিবর্তে ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গৃহস্থালিতে মিটারে যারা গ্যাসের বিল দেন, তাদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ব্যবহারের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ১০ পয়সার পরিবর্তে ১২ টাকা ৬০ পয়সা করা হয় সে সময়।

অর্থাৎ, রান্নার গ্যাসের জন্য চুলাভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি মাসে ২৩ শতাংশ এবং মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের ৩৮ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ বাড়ে।

যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা করা হয়, যা আগে ছিল ৩৮ টাকা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত।

মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতায় ব্যবসায়ীরা

বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

বুধবার রাতে এফবিসিসিআইয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা শিল্পের প্রতিযোগীতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। মহামারীকালে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো ব্যাহত হবে।

বুধবার এফবিসিসিআই কার্যালয়ে পাওয়ার, এনার্জি, ইউটিলিস বিষয়ক এফবিসিসিআইর স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রথম সভাতেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বৈঠকে এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চীন ও ভারত আরো ২০ বছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখবে। বাংলাদেশেও শিল্পের বিকাশের স্বার্থে দেশে মজুদ থাকা কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া উচিত সরকারের।

গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, বাপেক্স একা না পারলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে অনুসন্ধান কূপ খননে গতি আনা উচিত।

স্ট্যান্ডিং কমিটির ডিরেক্টর-ইন-চার্জ ও এফবিসিসিআইর পরিচালক আবুল কাশেম খান বলেন, দেশে জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ নয়। দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও শিল্পায়ন অব্যাহত রাখতে দেশীয় সম্পদকে কাজে লাগানো জরুরি।

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ওয়ান স্টপ সলিউশন, চরের অনাবাদী জমিতে সোলার প্যালেন স্থাপন, সরকারিভাবে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া, বর্জ্য ও চালের কুড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নেওয়ার দাবি জানান কমিটির সদস্যরা।