নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে বাপা ও বারভিডায় প্রশাসক

নির্বাচন আয়োজন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনে (বাপা) প্রশাসক বসিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; একই ধরনের অচলাবস্থার মধ্যে প্রশাসক বসেছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন- বারভিডাতেও।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2022, 06:11 AM
Updated : 13 Jan 2022, 06:11 AM

বাপার একটি পক্ষ প্রশাসক নিয়োগের বিরোধিতা করে নতুন কার্যকরি কমিটি গঠনের চেষ্টা করলেও মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়নি। ফলে এ সংগঠনে এখন একটি নির্বাচিত কার্যকরি কমিটি আছে, আবার মন্ত্রণালয়ের বসানো প্রশাসকও আছেন। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষই এখন সঙ্কট সমাধানে নতুন বরে আলোচনা শুরুর অপেক্ষায়।

বারভিডার নির্বাচন আটকে গেছে কার্যকরী কমিটির সাবেক এক সদস্যের রিট মামলার কারণে। সেখানে প্রশাসক বসিয়ে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

দুই বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্বের জটিলতা নিয়ে এভাবে হস্তক্ষেপ করতে হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও সন্তষ্ট নন।  

মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা নীতি সহায়তা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে কাজ করার জন্য বসেছি। অথচ এখন (ব্যবসায়ীদের) দ্বন্দ্ব নিরসনেই সময় চলে যাচ্ছে। এসব সংগঠন ও তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।”

এ দুই সমিতিতে ভোটার তালিকা, নির্বাচনী তফসিল, নির্বাচনী বোর্ড, আপিল বোর্ডসহ বিভিন্ন ধাপে ব্যবসায়ী নেতাদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মীমাংসার উদ্যোগ নিলেও সব পক্ষ তাতে সন্তুষ্ট নয়। বিষয়গুলো বিভিন্ন সময়ে আদালতেও গড়িয়েছে।

বাপায় জটিলতার শুরু যেভাবে

বাপার সদ্য সাবেক পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সমিতির এক সদস্যের আপিলের কারণে পুরানো ভোটার তালিকা থেকে বড় কোম্পানিগুলোর ৫৯টি ভোট বাতিল হয়ে যায়। সেখান থেকেই বিরোধের শুরু।

“এরপর নির্বাচন কমিশনের তফসিলে গোঁজামিল ও এফবিসিসিআইয়ের রায় জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।”

ইকতাদুল হক জানান, তফসিলে ভোটার হওয়ার শর্তাবলীর মধ্যে তৃতীয় শর্ত ছিল কোম্পানির ক্ষেত্রে বোর্ড রেজুলেশনের মাধ্যমে তারা প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। প্রোপাইটর কোম্পানির ক্ষেত্রে মালিক নিজে, এবং অংশীদারী ব্যবসার ক্ষেত্রে একজন পার্টনারকে ভোটার হিসাবে রাখার কথা।

১৯৯৮ সালে বাপার সূচনা থেকে এমনটাই রেওয়াজ ছিল এবং ব্র্যাক, ফ্রেশ, বসুন্ধরা, এসিআইয়ের মতো বড় কোম্পানিগুলো এই শর্ত মেনেই ভোটার হয়েছে বলে জানান তিনি।

ইকতাদুলের ভাষ্য, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বাপার একজন কার্যকরী সদস্য নির্বাচন আপিল বোর্ডের কাছে বড় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের ভোটার হওয়া নিয়ে আপত্তি জানায়। আপিল মীমাংসা করে রায় দেয় আপিল বোর্ড।

তাতে বলা হয়, যেহেতু শুরু থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে, চলমান কমিটিতেও বিডিফুড ও স্কয়ারের মতো কোম্পানির প্রতিনিধি আছে, তাই নির্বাচনটাও রীতি মেনে করে ফেলা যায়। পরে নতুন পর্ষদ (আপিলে উত্থাপিত) বিষয়টি মীমাংসা করতে পারবে।

আপিল বোর্ড সিদ্ধান্ত দেয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তারপর নির্বাচন করতে হবে। এই ‘প্রণয়নের’ অর্থ হচ্ছে নির্মাণ বা পুনর্গঠন।

এর ভিত্তিতে বাপার নির্বাচন কমিশন বড় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের বাদ দেয়, কিন্তু নতুন কাউকে যুক্ত করেনি। বাদ পড়া ভোটারদের মধ্যে প্রাণ, স্কয়ার, বিডিফুড, ডেনিশ, বনফুল, কাজী গ্রুপ, গোল্ডেন হারভেস্ট, বসুন্ধরার মত বড় কম্পানিগুলোর ৫৯ জন সদস্য ছিলেন।

ইকতাদুল বলেন, “বাদ পড়া ভোটাররা আদালতে গিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। তারা এফবিসিসিআইয়ের আরবিট্রেশনে দুটি আবেদন করেন। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই থেকে রায় আসে, কোনো সদস্যের পর পর দুই বারের বেশি নির্বাচন করার সুযোগ নাই।

“এদিকে চলমান তফসিলে টিকে যাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে চারজন ছিলেন, যারা তৃতীয়বার নির্বাচনে লড়তে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে বাদ পড়ারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যান। এটা ছিল সংকটের দ্বিতীয় ধাপ।”

বাপার নির্বাচন কমিশন গঠন ও পুনর্গঠন

ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়া পর্ষদ সদস্যরা তাদের দাবি আদায় করতে না পেরে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু মোতালেবের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সরিয়ে আরেকটি কমিশন বানায়।

ইকতাদুল বলেন, ৯০ দিনের মেয়াদ নিয়ে ২০২০ সালের শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু মোতালেবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ওই নির্বাচন কমিশন। চলমান মহামারীর কারণে ৯০ দিনের বাধ্যবাধকতা ডিসেম্বর পর্যন্ত শিথিল করে সরকার। এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম তফসিল ঘোষণার পর ভোটার তালিকা নিয়ে সংকট আবার সামনে আসে।

“বিষয়টি এরইমধ্যে কয়েকবার আদালতেও গড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত আবু মোতালেব কমিশনের মেয়াদ শেষে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে নিয়ে আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই আদালতের আদেশের সূত্র ধরে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন করে আবু মোতালেব কমিশন।”

আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আবু মোতালেব বলেন, “বাপার সদ্য সাবেক পর্ষদই অবৈধভাবে আরেকটা ইলেকশন কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু তারা এটা পারে না। ইলেকশন বোর্ড একবার গঠন হলে সেটা আর বাদ হয় না। এটাকে বাদ দিতে হলে ইলেকশন বোর্ডের অনিয়মের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানাতে হয়।

কিন্তু দ্বিতীয়বার যে বোর্ড গঠন হয়েছিল, তারাও তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে পারেনি।

নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক

আগে গঠিত আবু মোতালেবের নির্বাচন কমিশনের অধীনেই ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করেন মমতা ফুডের মালিক নুর খান।

মন্ত্রণালয় ওই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রীয়তা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। ওই রিটের ফলে আদালত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়, আদেশ পাওয়ার ১০ কর্মদিবসের মধ্যে মমতা ফুডের বিষয়টি মীমাংসা করতে হবে।

বাপার সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল বলেন, “আদালতের আদেশের মানে এই নয় যে, ১০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু ওই আদেশ ব্যবহার করে অন্য পক্ষ মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ ডিসেম্বর একটা চিঠি আনে।”

সেই চিঠি দেখিয়েই আবু মোতালেব ২৯ ডিসেম্বর ভোট আয়োজন করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা সংবিধান অনুযায়ী ভোটার তালিকা করেছিলাম। একজন প্রার্থী আমার বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে। তাদের ভোটার করে নেওয়ার জন্য আমিও চেষ্টা করেছি। সমস্যাগুলো সমাধানে তিন মাস সময়ও দিয়েছি। কিন্তু তারা এগুলোর সমাধান করে নাই। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়।

“বাপা পর্ষদের একটা পক্ষ ইলেকশনের দুই দিন আগে নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ড বাতিল করে, যেটা তারা পারে না। সেই অধিকার ইসি কমিটির থাকে না। এটা করতে হলে আমার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে সেখান থেকে করতে হবে, না হয় হাইকোর্টের আদেশ এনে করতে হবে।”

তিনি দাবি করেন, “৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য ২৫ তারিখ আমার কাছে চিঠি আসে মন্ত্রণালয় থেকে। পরে দুই পক্ষই বিষয়টি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির সঙ্গে বসে। দুই পক্ষই সমঝোতাও করে। শেষ মুহূর্তে একপক্ষ ঘুরে যায়।

“এই পরিস্থিতিতে আমরা ২৭ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন করে ফেলি। এরই মধ্যে তারা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছিল, সেটাও খারিজ হয়ে যায়। এখন এই পরিস্থিতিতে তারা ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগের একটি আদেশ নিয়ে আসে।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার একদিন পর ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বাপার নির্বাচন হয় এবং ১৭১ জন ভোটারে মধ্যে ৯৮ জন ভোট দেন বলে জানান নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন।

তারপর প্রশাসক

এদিকে নির্বাচনের পর নতুন পর্ষদ গঠন হলেও ২৯ ডিসেম্বর প্রশাসক হিসাবে বাপায় যোগ দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জিন্নাত রেহানা। বাপার সদ্য সাবেক সভাপতি ফখরুল ইসলাম মুন্সির আবেদনে এই প্রশাসককে নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিও শাখার যুগ্মসচিব ওয়াহিদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হয়েছে। এখন জটিলতা দূর করার চেষ্টা চলছে। আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা পেলে আমরা সেটাও অনুসরণ করতে পারব।”

প্রশাসক নিয়োগের বিরোধিতা

নিজেকে ভোটে নির্বাচিত সভাপতি দাবি করে বাপায় প্রশাসক নিয়োগের বিরোধিতা করছেন এস এম জাহাঙ্গীর আলম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আদালতের রায়ের বাধ্যবাধকতায় নির্বাচন হয়েছে। ১৫ সদস্যের কার্যকরী পর্ষদও গঠিত হয়েছে।

“এখন প্রশাসক দিয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। তারাই (মন্ত্রণালয়) নির্বাচন করতে বলল, আবার তারাই প্রশাসক নিয়োগ করল। আমরা আবেদন জানিয়েছি প্রশাসক প্রত্যাহার করার জন্য। হয়তো সাত-আট দিন অপেক্ষা করতে হবে।”

প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ‘উচিত হয়নি’ মন্তব্য করে আগের নির্বাচন কমিশনার আবু মোতালেব বলেন, “একদিকে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। আরেক দিকে ২৯ তারিখ প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে আমাকে না জানিয়ে। মন্ত্রণালয় এটা ঠিক করে নাই।”

মন্ত্রণালয়ের প্রশাসক নিয়োগের আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।

বারভিডাতেও প্রশাসক

আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও ভোটার তালিকায় জটিলতার কারণে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন- বারভিডায়।

বারভিডার জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তা জাকারিয়া মাহমুদ জানান, বারভিডার বর্তমান কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তারা মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন করতে পারেনি। এছাড়া সমিতির সাবেক এক সদস্য আনোয়ার সাদাতের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

“আনোয়ার সাদাত আগেরবারের ২৫ সদস্যের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। অনিয়মের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। গত দেড় বছর ধরে তিনি ভোটার নন। এখন তিনি সদস্য পদ ফিরে পেতে ও ভোটার হতে রিট করেছেন।”

এই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ শাখার উপ সচিব ছাদেক আহমকে সংগঠনের নতুন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।

জাকারিয়া বলেন, “প্রশাসক ছয় মাসের মধ্যে নতুন ভোটার তালিকা করে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবেন।”