শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ৫০ হাজারের বেশি দর্শনার্থীর কোথাও কোথাও ঠেলাঠেলি আর কোথাওবা গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো ও কেনাকাটায় মেলা প্রাঙ্গণে যেন উধাও স্বাস্থ্যবিধি।
মেলায় মাস্কবিহীন ঘুরে বেড়াতে যেমন দেখা গেছে, তেমনি দূরত্ব মানার চিত্রও দেখা যায়নি।
করোনাভাইরাস মহামারীতে এক বছর বন্ধ থাকার পর এবার নতুন ঠিকানায় রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলের ৪ নম্বর সেক্টরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে গত ১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে বাণিজ্য মেলা। প্রথম ছয় দিন মেলায় দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম।
তবে শুক্রবার দুপুরের পর বলার মতো ভিড় বাড়তে শুরু করে বলে জানান অংশগ্রহণকারী বিক্রেতারা। বিকাল থেকে সন্ধ্যা গড়ানোর সঙ্গে মানুষের ভিড়ও বেড়েছে। সন্ধ্যার পরও মেলায় প্রবেশের অপেক্ষায় বাইরে লাইনে ছিলেন অনেকে।
এরপরও মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকেই মাস্ক খুলে ফেলছেন দর্শনার্থীরা। বেশির ভাগের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি; কারওবা মাস্ক থুতনিতে। এভাবেই বিভিন্ন স্টলে ঘুরছেন দর্শনার্থীরা। কেউ আবার মাস্ক খুলে মোবাইলে সেলফি তুলছেন।
বিশ্বজুড়ে নতুন করে সংক্রমণ বাড়াতে থাকা করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশেও। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ২০ জনের এ ধরনে আক্রান্ত হয়েছে বলে খবর এসেছে।
এছাড়া গত এক সপ্তাহে সংক্রমণও দ্রুত বাড়ছে। শুক্রবার ১৫ সপ্তাহ পর দৈনিক নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত কোভিড রোগীর হার আবার ৫ শতাংশের উপরে উঠে গেছে।
চার মাসের বেশি সময় পর বৃহস্পতিবার দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১০০ ছাড়িয়েছে। শুক্রবারও ১ হাজার ১৪৬ জন কোভিড শনাক্ত হয়েছেন।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ঠেকাতে মঙ্গলবার দেশে ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যেখানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জনসমাগমে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
সংক্রমণ এড়াতে সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিলেও মেলায় বিষয়টি মানতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন স্টল, খাবারের দোকানে মাস্ক ছাড়াই ঘোরাঘুরি করেছেন ক্রেতারা।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে পরিবার নিয়ে মেলায় এসেছেন রবিউল ইসলাম। চারজনের এই দলের কারও মুখেই মাস্ক নেই।
মিরপুর থেকে আসা কয়েকজন তরুণের একটি দলের কারও মুখে মাস্ক নেই। জানতে চাইলে আশিকুর রহমান নামে একজন বলেন, “মাস্ক বেশিক্ষণ মুখে পরে থাকা যায় না। দম বন্ধ হয়ে আসে।”
মেলাজুড়ে এমন চিত্র দেখে আশঙ্কার কথা জানালেন আশকোনা থেকে আসা মাহতাব উদ্দিন পাভেল। তিনি বলেন, “বেশির ভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। লোকজনের ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার তো কোনো সুযোগই নাই। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে এটাই। এভাবে করোনাভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ে কিনা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত ছিল।”
জানতে চাইলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পরিচালক মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মেলার স্টলগুলো সাজানো হয়েছে স্বাস্থ্যবিধির কথা মাখায় রেখে। দুটি স্টলের মাঝখানে অনেক জায়গা রাখা হয়েছে, মেলা প্রাঙ্গণেও প্রচুর খালি জায়গা রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি ঠিক রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা চলছে।
“মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কিছু অসচেতন মানুষ আছে মেলায় ঢোকার পর মাস্ক মুখে রাখে না।
আমাদের মোবাইল টিম আছে, মাস্ক ছাড়া দেখলে তাদের মাস্ক পরতে বলছে। প্রতিটি দোকানে বলে দেওয়া হয়েছে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নিশ্চিত করতে। এমনকি দোকানে যারা থাকবেন তাদেরও যেন মাস্ক পরা নিশ্চিত করা হয়।”
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এ অবস্থায় ব্যাপক জনসমাগম সংক্রমণের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে।
“শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ওখনও হয়নি, কিন্তু হওয়ার মুখে। বাণিজ্য মেলা খোলা জায়গায় হলেও সেখানে নানা দোকানপাট আছে। যদি মাস্ক পরা না থাকে, গায়ে গা লাগিয়ে চলাফেরা করে তাহলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।“
বাণিজ্য মেলা হোক, রাজনৈতিক কর্মসূচি হোক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান- সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ থাকার পরামর্শ তার।
মেলার পরিচালক ইফতেখার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মেলায় এক লাখের বেশি দর্শনার্থীর জায়গা দেওয়া যাবে। শুক্রবার প্রায় ৫০ হাজারের বেশি দর্শনার্থী এসেছে।
শুরুর দিকে দর্শনার্থী কম থাকায় হতাশ স্টল মালিকরা আশা দেখছেন সামনে আরও বেশি মানুষ আসার।
শুক্রবার ইলেকট্রনিক্স, কসমেটিকস, ক্রোকারিজ ও খাদ্যপণ্যের স্টলগুলোর সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি।
ঢাকার লালবাগ থেকে স্বামীসহ এসেছেন সায়মা আক্তার। তিনি বলেন, দূরত্ব বাড়াসহ নানা কারণে এবারের মেলা ভালো লাগছে না তার।
“আগের মেলা প্রাঙ্গণ অনেকটাই খোলামেলা ছিল। স্টলগুলোও বড় আকারের ছিল। কিন্তু এবারের মেলা কেমন জানি ছোট ছোট স্টল। আগের মতো লাগছে না।”
স্কয়ার কনজুমার প্রডাক্টসের স্টলের হিসাবরক্ষক অপু দাস বেলা সাড়ে চারটার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ছয় দিনের চেয়ে বেশি দর্শনার্থী এসেছে শুক্রবার বিকাল হওয়ার আগেই। বিক্রিও বেড়েছে।
মিনিস্টার হাইটেক পার্ক লিমিটেডের বিভাগীয় ম্যানেজার এফ এম মাহফুজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মেলার স্টলের জায়গা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে মালামাল রাখতে পারছেন না তারা। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দেওয়া যাচ্ছে না।
“ওয়্যারহাউজ করতে পারি নাই, প্রডাক্ট রাখতে পারছি না। ডিসপ্লে থেকে প্রডাক্ট দিতে হচ্ছে। বেচাবিক্রি কম হচ্ছে।”
ওয়ালটনের বিক্রয়কর্মী নাঈম সরদার বলেন, ঢাকা থেকে দূরত্ব, মেলায় ছোট ছোট স্টলসহ নানা কারণে লোক সমাগম কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
“স্টল ছোট হওয়ায় প্রডাক্ট বেশি রাখা যাচ্ছে না। ডিসপ্লেও বেশি করা যাচ্ছে না।”
হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান জয়িতার বিক্রয়কর্মী সেলিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বুধবার স্টল চালু করেছেন। শুক্রবারই লোক এসেছে বেশি। তবে বিক্রি খুব বাড়েনি।