বাগদার জিআই সনদের সম্ভাবনা জাগাচ্ছে আশা

অন্য কোনো দেশ আপত্তি না তোলায় বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে জিআই সনদ পাওয়া এখন কেবল ‘সময়ের ব্যাপার’; আর এই সুখবরে আশাবাদী হয়ে উঠছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2021, 08:49 AM
Updated : 10 Dec 2021, 12:36 PM

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস হুমায়ুন কবির বলছেন, জিআই সনদ পেলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, তেমনি এ পণ্যের জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দাম পাওয়া যাবে বলে তারা আশা করছেন।

বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় কালো ডোরাকাটা বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। গত শতকের সত্তরের দশকের পর বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়তে শুরু করলে বাংলাদেশেও বাগদা চাষের সম্প্রসারণ ঘটে। আশির দশকে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের তালিকায় যুক্ত হয় এ চিংড়ি।

পৃথিবীতে বাগদা চিংড়ির প্রজাতি আছে পাঁচশর বেশি। অন্যান্য চিংড়ির তুলনায় কালো ডোরা কাটা বাগদা একটু চ্যাপ্টা আকারের। বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় চাষ হওয়া চিংড়ির ৮০ শতাংশই ব্ল্যাক টাইগার শ্রিম্প বা বাগদা। তবে এ চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মত কয়েকটি দেশের দখলে।

বিশ্ব বাজারে বাগদা চিংড়িকে বাংলাদেশের বিশেষায়িত পণ্য হিসেবে তুলে ধরতে ২০১৯ সালের মে মাসে মৎস্য অধিদপ্তর জিআই স্বীকৃতি জন্য আবেদন করে। চলতি বছরের ৬ অক্টোবর সরকারের পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস বিভাগ গেজেট জারি করে এবং দুটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করে।

নিয়ম অনুযায়ী জার্নালে প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে কেউ আপত্তি না করলে সেই পণ্যের জিআই সনদ পেতে আর কোনো বাধা থাকে না। বাগদার ক্ষেত্রে সেই সময় গত ৬ ডিসেম্বর শেষ হয়।

এর মধ্যে কেউ আপত্তি তোলেনি জানিয়ে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের উপ নিবন্ধক এ কে এম শওকত আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির জিআই সনদপ্রাপ্তি এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতার বিষয়। চলতি মাসের মধ্যেই সনদ হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।”

জিআই সনদ কী

ভৌগলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন- জিআই) হচ্ছে- একটি প্রতীক বা চিহ্ন, যা পণ্য ও সেবার উৎস, গুণাগুণ ও সুনাম ধারণ ও প্রচার করে।

কোনো দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ যদি কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো গুরুত্ব রাখে, সেই দেশের সংস্কৃতির সাথে যদি বিষয়টি সম্পর্কিত হয়, তাহলে সেটাকে সে দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) জিআই সনদ দেয়।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হওয়ার পর সে আইনের বিধিমালা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক সামগ্রী হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি। পরের বছর ইলিশ এবং ২০১৯ সালে ক্ষীরষাপাতি আমকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এরপর চলতি বছরের জুনে একসঙ্গে স্বীকৃতি পায় ঢাকাই মসলিন, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, নেত্রকোণার বিজয়পুরের সাদামাটি ও বাংলাদেশের কালিজিরা চাল।

এবার বাগদা চিংড়ির সাথে ফজলি আমও জিআই সনদ পেতে যাচ্ছে। ফলে এসব পণ্যে আলাদা ট্যাগ বা স্টিকার ব্যবহার করা যাবে। প্রাকৃতিক উপায়ে পণ্য উৎপাদন করে সব গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে বাজারজাত করতে হবে। আলাদাভাবে চিহ্নিত হওয়ায় রপ্তানিতে তুলনামূলক বেশি দাম পাওয়ার সুযোগ থাকবে।

কী লাভ হবে?

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৩৩ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়।

এসব এলাকার ঘেরের মালিক ও খামারিরা তাদের উৎপাদিত চিংড়ি নিজেরা আড়তে সরবরাহ করেন। আর হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকরা আড়তদার ও এজেন্টদের কাছ থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করেন।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, “জিআই সনদ না থাকায় আমরা এতদিন বাগদার ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি। অন্য দেশগুলো সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু এখন এই সেক্টরের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ এসেছে।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি রপ্তানি হয়। যুক্তরাজ্যও চিংড়ির বড় বাজার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাপানেও যায় বাংলাদেশের চিংড়ি। কিন্তু জিআই সনদ না থাকায় দাম মেলে কম।

“ক্রেতারা এখন এটাকে ব্র্যান্ডেড পণ্য বলে মনে করেন না। ফলে এই সেক্টরের অনেক কোম্পানি রুগ্ন হয়ে পাড়েছে। এখন যেহেতু বাগদা বাংলাদেশের ব্র্যান্ডেড পণ্য হচ্ছে, তাই আমাদের পণ্য হতে হবে সর্বোচ মানসম্মত, প্রথমশ্রেণির। এখানে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির চিংড়ি রপ্তানির সুযোগ নেই।”