বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সম্প্রতি দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে পাঠাওয়ের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ফাহিম আহমেদ সেবার পরিধি বাড়াতে ফিনটেক (আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার) ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টি যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি প্রতিটি ব্যবসায় এখন মুনাফায় থাকার দাবিও করেছেন।
পাশাপাশি কোম্পানির ছয় বছরের পথচলা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেন তিনি।
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা নগরীতে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক পার্সেল সেবা দিয়ে যাত্রা শুরু করা পাঠাও আলোচনায় আসে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে।
শুরুটা সাড়া জাগিয়ে হলেও বছর কয়েক পর নানা কারণে সমানতালে চলতে পারেনি দেশি স্টার্টআপটি। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়া রাইড শেয়ারিং কোম্পানিটি এখন ঘুরে দাঁড়নোর চেষ্টা করছে।
যাত্রীকে বাইকে ওঠানোর আগে হেলমেট পরিয়ে দিচ্ছেন এক রাইডার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) হিসেবে ২০১৮ সালে পাঠাওয়ে যোগ দেওয়া ফাহিম শুরু থেকে কোম্পানির এমডির দায়িত্বে থাকা সহপ্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াসের স্থলাভিষিক্ত হন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত আড়াই বছরে ব্যবসাটা টেকসই পর্যায়ে স্থানান্তর করা গেছে। পাঠাওয়ের প্রতিটি ব্যবসাই এখন লাভজনক। ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিক থেকে আমরা লাভে আছি।
“করোনার আগের সময়ের চেয়ে বেশি পরিসরে এখন কাজ করছি।“
ফিনটেকে কী থাকছে
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকায় অ্যাপভিত্তিক পার্সেল সেবা দিয়ে যাত্রা শুরু করে পাঠাও মাত্র এক বছরের মাথায় মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং বা যাত্রী পরিবহন সেবা চালু করে।
পরের বছর যুক্ত হয় কার রাইড শেয়ারিংয়ে এবং এর কিছুদিন পর ফুড ডেলিভারি সেবায়। ছয় বছরের মাথায় ভিন্ন মাত্রার অনলাইনে আর্থিক সেবা দিতে ফিনটেক ব্যবসায় হাত দিচ্ছে কোম্পানিটি।
“বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট সিস্টেম প্রভাইডার হিসেবে এনওসি পেয়েছে পাঠাও।“
আগামী বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের ভিত্তিতে সেবাটি চালু করা যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
কী কী সেবা নিয়ে ফিনটেক চালু হচ্ছে? জানতে চাইলে তরুণ এ নির্বাহী বলেন, ১০/১২দিন আগে (১৫ নভেম্বর) ‘পে লেটার’ সেবা চালু করেছি।
“এর মাধ্যমে সবচেয়ে রেগুলার ও বিশ্বস্ত গ্রাহকরা খাবার অর্ডার করে তাৎক্ষণিক পরিশোধ না করে, পরেও পরিশোধ করতে পারবেন।”
এ সেবাকে আরও বিস্তৃত করতে চায় পাঠাও। মাসে মাসে নতুন নতুন গ্রাহকদের এ সেবার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে দেশি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি।
ভিসা ও মাস্টারকার্ডের সঙ্গে পার্টনারশিপ করার আগ্রহের কথা জানিয়ে সিইও ফাহিম বলেন, যাদের মাধ্যমে আমাদের ইউজারদের মাঝে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে দিতে পারব।
“দেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তরুণ। তাদের ক্রেডিটের এক্সেস খুবই কম। দেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১৭ লাখের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাকেন। এর মধ্যে তরুণদের ক্রেডিট এক্সেস কম। কারণ তাদের সেলারি হিস্ট্রিটা কম। ‘পে লেটার’ সেবাটির মাধ্যমে এ ঘাটতি মেটাতে চাই।”
নেটওয়ার্কে তিন লাখের বেশি চালক, ফুড ‘ডেলিভারি ম্যান’ যুক্ত হয়েছেন। ১০ হাজারের বেশি রেস্টুরেন্ট, ৩০ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য ডেলিভারি সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ৩০ হাজার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১২ হাজারের (৪০%) বেশি নারী।
নতুন সেবা আনার মাধ্যমে তরুণদের আয়ের পথ সুগম করতেও ভূমিকা রাখছে পাঠাও বলে উল্লেখ করেন নতুন সিইও।
প্রধান নির্বাহী পদে কেন পরিবর্তন?
দেশি রাইড শেয়ারিং ও ডিজিটাল সেবার প্ল্যাটফর্ম পাঠাও নতুন নির্বাহী হিসেবে গত ১ নভেম্বর সিএফও ফাহিম আহমেদকে বেছে নেয়।
আগের সিইও ও কোম্পানির সহ প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াসের জন্য সৃষ্টি করা হয় ‘সিনিয়র অ্যাডভাইজার’ এর পদ।
যাত্রা শুরুর ছয় বছরের মাথায় প্রধান নির্বাহী পদে কেন এত বড় পরিবর্তন? এ প্রশ্নের উত্তরে ফাহিম হাজির করেন ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিভিন্ন প্রসঙ্গ।
পাশাপাশি গত চার বছরে এ প্রতিষ্ঠানে তার দক্ষতা ও তৎপরতাকে এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা ও দীর্ঘদিন চাকরি করা এ কর্মকর্তা।
“গত দুই বছর ধরেই পাঠাও একটা রূপান্তরের দিকে যাচ্ছিল। প্রতিটি ব্যবসাকে সফল করা বা টেকসই করার চেষ্টা চলছিল। সেই সময় থেকেই সিএফও হিসেবে আমার ভূমিকা দিয়ে বর্তমান অবস্থানটা এনসিওর করলাম,” বলেন প্রত্যয়ী ফাহিম।
রাজধানীর ফার্মগেটে শুক্রবার পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীর অপেক্ষোয় মোটর বাইকের রাইড শেয়ারিংয়ের চালকরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
সহপ্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কোম্পানির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থাকছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ইলিয়াস হচ্ছে আমাদের অনুপ্রেরণা। তার ‘ভিশন’ ও উৎসাহ যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করেছে।
“আমরা খুব ‘ক্লোজলি’ কাজ করি। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতিটা আরও বাড়বে, পার্টনারশিপের ধরনটা আরও বিস্তৃত হবে।“
ছাঁটাই প্রসঙ্গ
যাত্রা শুরুর চার বছরের মাথায় বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকশত কর্মীকে ছাঁটাই করেছিল পাঠাও। একটি নতুন কোম্পানিকে বিপুল এ ছাঁটাই কেন করতে হয়েছিল- প্রশ্ন করা হয় নতুন সিইওকে।
ফাহিম বলেন, একটি ব্যবসা যখন শুরু হয় তখন মুনাফার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু প্রবৃদ্ধির ওপর নজর থাকে। গ্রাহকের আস্থা অর্জন ও বিস্তৃতির দিকে বেশি নজর থাকে। প্রণোদনা দিয়ে গ্রাহক টানার চেষ্টা করে।
প্রথম দিকে সেরকম চেষ্টায় ছিল পাঠাও। কিন্তু একটা পর্যায়ে ব্যবসাকে টেকসই করার স্বার্থে খরচের খাতাটা সঙ্কোচন করার দিকে নজর দিতে হয়, এক্ষত্রেও তেমন করতে হয়েছিল বলে নতুন সিইও এর ব্যাখ্যা।
অন্যান্য খরচের ব্যাপারেও এখন সাবধানতা অবলম্বনের কথা জানিয়ে ‘রিটার্ন’ কী হবে সেটা বিশ্লেষণ করে এগোনো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে লকডাউনে সারা দেশ, চলাচলেও রয়েছে বিধিনিষেধ। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ থাকলেও এর মধ্যেই ঢাকার গাবতলীতে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালককে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
নতুন বিদেশি বিনিয়োগ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
বাংলাদেশের পুরো স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে যে বিনিয়োগ আসছে পাঠাও এর অগ্রধারে রয়েছে উল্লেখ করে ফাহিম জানান, ইউএসএ, ইউকে, হংকং, সিঙ্গাপুর থেকে বিনিয়োগ এসেছে।
এখন পর্যন্ত ঘোষণা অনুযায়ী, সাড়ে তিন কোটি ডলার বা ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে। শিগগিরই নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে ঘোষণা আসবে বলে জানান তিনি।
নতুন পরিষেবা ফিনটেকের সম্প্রসারণ ও পুরোনো সেবাগুলোকে আরও শক্তিশালীকরা এবং সেবার পরিধি সম্প্রসারণে নতুন বিনিয়োগ ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে পাঠাও।
“কোর বিজনেসগুলো এখন সাসটেইনেবল। গত দেড় বছর ধরে সেই পথেই এগিয়ে আসছি। নতুন বিনিয়োগ এখনকার ভিত্তিকে সম্প্রসারণ করবে।
“ফিনটেক ও ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস চালু করা ও বিস্তৃত করার কাজে ব্যবহার করা হবে”, যোগ করেন ফাহিম।