এতে বাজেটের মধ্যে থাকতে হিমশিম অবস্থা অনেকের। তেমনি বাজেটে কুলোচ্ছে না বলে থমকে গেছে কিছু নির্মাণ কাজও; পরিকল্পনা করেও বসে আছেন অনেকেই।
বাজারের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রডের দাম সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। দরবৃদ্ধিতে ক্রমাগত উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে গত এক বছরেই উচ্চমূল্যের কাতারে পৌঁছে গেছে নির্মাণকাজের অত্যাবশক এ উপকরণ।
গত জানুয়ারির চেয়ে এখন প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে যে কোনো গ্রেডের রড।
এছাড়া ইট, বালু, পাথর, সিমেন্ট, থাইগ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, এসএস পাইপ, ইনডোর ফিটিংসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দামও বেড়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।
সরবরাহকারী, ডিলার কিংবা পাইকারি ও খুচরা বাজারমূল্যের পাশাপাশি ইট-বালি-সিমেন্ট ব্যবসায়ী, অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনকারী এবং আবাসন কোম্পানিগুলোর সমিতি রিহ্যাব নেতাদের দেওয়া তথ্যও নির্মাণ উপকরণের বাজার চড়া থাকার কথাই বলছে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রত্যেকটা নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে; রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর থেকে শুরু করে সব।
“এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রডে, ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ বেড়েছে। পাথরের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।“
তিনি জানান, কোভিড মহামারী শুরুর আগে ২০২০ সালে রডের দাম ছিল প্রতিটন ৫২ হাজার টাকা। এখন তা পৌঁছেছে ৭৩ হাজার টাকায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামালের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে কমেনি বলে অনুযোগ তার।
মিরপুর পীরেরবাগের রড সিমেন্টের খুচরা বিক্রেতা খালেদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভালো মানের রডের দাম প্রতিটন প্রায় ৭৩ হাজার টাকার কাছাকাছি।
বিশ্ববাজারে রডের প্রধান কাঁচামাল বিলেট ও স্ক্র্যাপের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ার প্রভাব দেশের বাজারে সামনের দিনেও কতটা পড়বে তা নিয়ে সতর্ক ব্যবসায়ীরা।
দেশের অন্যতম রড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রডের কাঁচামাল নিয়ে বিশ্বজুড়ে সাপ্লাইচেইনে একটা মিসম্যানেজমেন্ট হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে কাঁচামাল ইস্পাতের সরবরাহ কমে গেছে এবং দাম অনেক বেড়ে গেছে।
“আন্তর্জাতিক বাজারে এখন ইস্পাতের যে দাম আছে সেটির সঙ্গে সমন্বয় করলে দেশের বাজারে রডের দাম গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিটন ৮০ হাজার টাকায়।“
তবে কাঁচামালের কিছুটা (৩০ শতাংশ) যোগান দেশি উৎস থেকে যাচ্ছে এবং পুরোনো দামে কেনা কাঁচামাল থেকে এখনও কিছু রড উৎপাদন হচ্ছে তাই দামটা সেই পর্যায়ে যায়নি বলে দাবি তার।
দাম বাড়ার অন্যান্য কারণের মধ্যে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া এবং মহামারীর স্থবিরতা কাটিয়ে সারা বিশ্বেই ব্যাপকহারে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়াকে উল্লেখযোগ্য বলে জানান তিনি।
এছাড়া তুরস্ক, ব্রাজিল, ব্রিটেনসহ রপ্তানিকারক দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়া বর্তমান বাজারে অস্থিরতার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর।
সারাবিশ্বের ইস্পাতের চাহিদার অর্ধেকটাই চলে যায় চীনের নির্মাণ তৎপরতায়। বিশ্বে এ উপকরণের মূল্য নির্ধারণে তাই দেশটির ভূমিকা বড় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে কারখানা মালিকরাও নতুন করে কাঁচামাল কিনছেন না। অর্থাৎ পেনিকের কারণে উৎপাদনও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগে থেকে যারা ইস্পাত কিনে রেখেছিলেন তারাই এখন উৎপাদনে আছে।“
বাজার স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে বলে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। “দাম আরও বাড়বে না কমবে সেটা পরে বোঝা যাবে,” যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর গাবতলীতে আমিন বাজার সেতুর পাশে বালুঘাট এলাকায় রয়েছে ইট, বালি, পাথরসহ নির্মাণ শিল্পের বেশ কিছু উপকরণের দোকান।
সেখানে নিউ রাজধানী নির্মাণ সেন্টারের বিক্রেতা আব্দুল মুমিন বলেন, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাথরের দাম প্রতি বর্গফুট ২২০ টাকা থেকে ২৩০ টাকায় উঠেছিল। এখন কমে ১৮০ টাকায় নামলেও তা স্বাভাবিক দরের চেয়ে বেশি। মূলত প্রতি বর্গফুট ১৬০ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে থাকলে সেটাকে স্বাভাবিক বাজার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
“মহামারীতে গত দুই বছর দেশে পাথর আমদানি কম হয়েছে। লকডাউন শেষে নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরুর পর দাম বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার কমে আসছে,“বলেন মুমিন।
ইট বিক্রেতা শাহীন আহমেদ বলেন, এখন ইটের সিজন শেষের দিকে তাই দামটা একটু বেশি। শীতের শুরুতে নতুন ইট কাটা শুরু হলে দাম কমে আসবে। এখন মানের দিক থেকে দ্বিতীয় সারির ইট বিক্রি হচ্ছে প্রতিগাড়ি (৩০০০) ২৪ হাজার টাকায়। ভরা মওসুমে এ দাম থাকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে।
“এক নম্বর ইট বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার থেকে ২৭ হাজার টাকায়। এছাড়া সিঙ্গাইরের অটো ব্রিকসের ইট বিক্রি হচ্ছে ৩২ হাজার টাকায়। ইটের দাম প্রতি গাড়িতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বেড়েছে।“
বালু ব্যবসায়ী বাসেত ও সাইদুরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে এক গাড়ি (১৯০ থেকে ২০০ ফুট) সিলেকশন বালুর দাম ৮৫০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। এ মুহূর্তে দামটা একটু কমলেও গত দুই মাস ধরে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি ছিল।
ইট, বালু, পাথরের মতো থাই গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, এসএস পাইপসহ নির্মাণ কাজের আবশ্যক পণ্যের দামও গত এক বছরে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে বলে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
রাজধানীর মহাখালীতে একটি ভবনসজ্জা দোকানের সত্ত্বাধিকারী আবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম ৩০ শতাংশ ও গ্লাসের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
মীরেপুরের ৬০ ফিট সড়কের হাই মেটালের কর্মী নুরুল ইসলাম জানান, চলতি বছরে এসএস পাইপের দাম তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে। বছরের মাঝামাঝিতে ১৭ শতাংশ করে দাম বাড়ানো হয়েছিল। এর আগে ৫ শতাংশ করে দাম বেড়েছিল।
“সর্বশেষ গত সপ্তাহে আবার ১০ শতাংশ করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে কারাখানা মালিকদের কাছ থেকে।“
এ চড়া বাজারে কিছুটা স্বস্তি শুধু সিমেন্টের দামে। বেশ কিছু দিন ধরে একই রকম রয়েছে দাম। পীরেরবাগের রড সিমেন্টের খুচরা বিক্রেতা খালেদুর রহমান বলেন, এখন ৪২০ থেকে ৪৪০ টাকার মধ্যে ক্রাউন, শাহ সিমেন্টসহ প্রথম সারির ব্র্যান্ডের সিমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে।
“গত এক বছরে অতটা না বাড়লেও খুচরায় বিক্রেতাদের লাভের মার্জিন কমে গেছে। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় সব মিলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।“
গ্রেস বিল্ডার্সের কো অর্ডিনেটর খন্দকার আলী হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েকজন মিলে জমি কিনে ভবন নির্মাণের পর ফ্ল্যাট বিক্রি করেন তারা। এখন রডসহ পাইপ অ্যান্ড পিভিসি ফিটিংসের দামও অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে গত ছয় মাস তারা নতুন কোনো প্রকল্পে হাত দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারছেন না।
রাজধানীর ৬০ ফিট সড়ক এলাকায় একটি ভবন নির্মাণের পর তা এখন বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে গ্রেস বিল্ডার্স।
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানান একই এলাকার ক্রিয়েটিভ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপক জুবায়ের নাহিদ।
“এ মুহূর্তে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতাই সুখকর নয়। আবাসন খাতের ছোট উদ্যোক্তাদের এখন কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই। বড়দের সঙ্গে যোগাযোগ করুন,” বলেন তিনি।
রিহ্যাবের সদস্য আরমা রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নির্মাণ উপকরণের উচ্চমূল্যের কারণে এক বছর ধরে তাদের চলমান তিনটি প্রকল্পই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এক বছরে টানা লোকসান গুনতে গিয়ে এখন তিনি প্রায় ধরাশায়ী। এ পরিস্থিতি থেকে কিভাবে উত্তরণ হবে তাও জানা নেই।