এলপিজির দাম: দ্বিতীয় দফা শুনানিতেও খুলছে না ‘জট’

তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস- এলপিজির দাম নির্ধারণে এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় দফা গণশুনানিতে সমাধানের পথ তৈরি হয়নি; বরং অংশীজনদের বক্তব্যে এ নিয়ে আদালতে গড়ানোর কথাই বারবার উঠে এসেছে।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2021, 05:25 PM
Updated : 13 Sept 2021, 05:25 PM

তবে সোমবার দিনব্যাপী শুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল এবারের আদেশ যাতে সব পক্ষের কাছে সহনীয় ও গ্রহণীয় হয়, সেজন্য আলোচনার সুযোগ থাকার কথা জানিয়েছেন। তার আশা, এ বিষয়ে আবার আলোচনা হবে এবং তাতে অপারেটরগুলো অংশ নেবে।

সোমবার শুনানিতে বিইআরসি ও ক্যাবের বক্তব্যে এলপিজির দাম নির্ধারণে নতুন করে গণশুনানির বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ ও বিচারিক প্রক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসে।

দীর্ঘ শুনানিকালে শব্দচয়ন, ভাষার প্রয়োগ ও বিইআরসির আগের আদেশ অমান্য করা নিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই পাল্টাপাল্টি বাক্য বিনিময় হয়। উভয়পক্ষই প্রয়োজনে আদালতে গিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করার কথা বলেন।

আগের সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে কোম্পানির দাম বাড়ানোর আবেদন নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করায় বিইআরসি ও এলপিজি অপারেটরদের আদালতের কাঠগড়ায় নেওয়ার কথা বলেছে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সোচ্চার কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব।

আর নতুন করে দাম নির্ধারণের দাবি জানিয়ে কোম্পানিগুলো বিইআরসি নির্ধারিত বর্তমান মূল্য উপাদনগুলোর সঙ্গে আরও ২২৪ টাকার বিভিন্ন দায়ভার যোগ করার প্রস্তাব করে।

বিইআরসির সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে ১২ কেজির এলপিজিসি সিলিন্ডারের দাম ১০৩৩ টাকা হলেও অপারেটরগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী তা দাঁড়ায় ১০৯৭ টাকা।

ফাইল ছবি

যে কারণে দ্বিতীয় দফায় গণশুনানি

দেশে বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে এলপিজি বিপণন হলেও এতদিন দাম নির্ধারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কোনো উদ্যোগ আসেনি। আদালতের নির্দেশে গত ১৪ জানুয়ারি প্রথমবারের মত গণশুনানি হলেও দাম নির্ধারণের ঘোষণা আসেনি।

পরে গত ১২ এপ্রিল আদালতের নির্দেশেই প্রথমবারের মত মাসে মাসে সৌদি আরামকোর সিপি মূল্যেরভিত্তিতে এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণের ঘোষণা দেয় বিইআরসি।

তবে গণশুনানির রায় ঘোষণার দিন থেকেই বিভিন্ন ব্যয় অবমূল্যায়নের কথা বলে বিইআরসির ওই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে অপারেটরগুলো।

এরপর পাঁচ মাসে পাঁচবার এলপিজির নতুন মূল্যের ঘোষণা আসলেও এগুলোর কোনোটিই আমলে নেয়নি কোম্পানিগুলো। এমন পরিস্থিতিতে দাম পুর্ননির্ধারণে গত জুনে তারা আবার আবেদন করলে তা আমলে নেয় কমিশন।

দাম নির্ধারণ নিয়ে অপারেটরগুলোর সঙ্গে কমিশন ও ক্যাবের দ্বিমতের ‘জট’ খুলতে গত ১৭ ও ১৮ অগাস্ট বিইআরসি দ্বিতীয় দফায় গণশুনানির দিন ঠিক করে।

তবে এ নিয়ে ক্যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করে দেয় উচ্চ আদালত। এরপর সুপ্রিম কোর্টে বিইআরসির লিভ টু আপিলের প্রেক্ষিতে আগের আদেশ ছয় সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হলে নতুন শুনানির ক্ষেত্র তৈরি হয়।

দেশে এখন ছোট-বড় ২৭টি কোম্পানি এলপিজি আমদানি ও বোতলজাত করে বিপণনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। যদিও লাইসেন্স নিয়েছিল ৫০টি কোম্পানি।

আর শুনানি করতে আবেদন জমা দেয় ১৮টি কোম্পানি। তাদের আবেদনের ভাষা ও যৌক্তিকতা একই ধরনের হওয়ায় কমিশন সবার পক্ষ থেকে ছয় কোম্পানির প্রতিনিধিকে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেয়।

ঢাকার মিরপুরে তুরাগ নদের দিয়াবাড়ি ঘাট এলাকায় নৌকা থেকে এলপি গ্যাসের খালি সিলিন্ডার নামাচ্ছেন এক শ্রমিক। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শুনানি

সোমবার সকাল ১১টায় কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের সূচনা বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় শুনানি। বেলা দেড়টায় বিরতির আগ পর্যন্ত পেট্রোম্যাক্স এলপিজির পরিচালক নাফিস কামাল, ওমেরা এলপিজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল হক আহমেদ, বসুন্ধরা এলপিজির প্রতিনিধি জাকারিয়া জালাল, ওমেরা এলপিজির মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেন, বেক্সিমকো এলপিজির চিফ কমার্শিয়াল অফিসার মুনতাসির আলম দাম পুনর্নির্ধারণের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

বিরতির পর বিইআরসির কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন শেষে সন্ধ্যা পৌনে ৬টা পর্যন্ত চলে ভোক্তা প্রতিনিধিদের বক্তব্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এমএম আকাশ, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার তুরিন আফরোজ, এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপের সভাপতি সিরাজুল মাওলাসহ বেশ কয়েকজন ভোক্তা প্রতিনিধি এসময় বক্তব্য রাখেন।

শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, অপারেটররা গত ১২ এপ্রিল ঘোষিত মূল্যহার সংশোধনের আবেদন নিয়ে এসেছে। অথচ ওই মূল্যহারের কার্যকারিতা ৩০ তারিখেই শেষ হয়েছে। সেই হিসেবে এই শুনানি ও আলোচনা আইন ও প্রবিধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।

“এর সুরাহা করার জন্য এখন আমাদের সামনে আদালতে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। তবুও ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে শুনানির বাইরেও আলোচনার পথ খোলা রয়েছে।“

অপারেটরগুলোর যুক্তি

এলপিজি অপারেটরগুলোর প্রতিনিধি নাফিস কামাল শুনানিতে বলেন, শুধু সৌদি সিপির ওপর ভিত্তি করে মাসে মাসে এলপিজির দাম নির্ধারণের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। কারণ সৌদি সিপির (আন্তর্জাতিক পাইকারি মূল্য) পাশাপাশি জাহাজ ভাড়াও ওঠানামা করছে।

“অপারেটরদের গড় ব্যয় বিবেচনায় নেওয়ার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে খুচরা মূল্য ঠিক করতে হবে। এরপর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোম্পানিগুলো বাজার ধরতে নিজেদের মত করে দাম কমাবে। অন্যথায় ছোট কোম্পানিগুলো এই মূল্যহার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কারণ ছোট হওয়ার কারণে সেগুলোর অপারেটিং কস্ট বা ব্যয়ভার বেশি হয়ে যায়।“

একমাস আগের সৌদি সিপির ওপর ভিত্তি করে পরের মাসের এমআরপি বা খুচরা মূল্য নির্ধারণের বর্তমান আদেশ পরিবর্তন করার দাবিও জানান তিনি।

“মে মাসের সৌদি সিপি অনুযায়ী মে মাসের এমআরপি ঠিক করতে হবে। অন্যথায় সৌদি সিপির দাম বৃদ্ধির খবরে বাজারে মজুদ প্রক্রিয়া গড়ে উঠতে পারে”, যোগ করেন তিনি।

বসুন্ধরা এলপিজির প্রতিনিধি জাকারিয়া জালাল বলেন, “বর্তমান আদেশে মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ ‘লাভেল মার্জিন’ বিবেচনা করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই ব্যবসাবান্ধব নয়। এলপিজি বোতলের অবচয়ন আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরা হয়েছে। সেটাকে ১০ বছর করা প্রয়োজন।“

এছাড়া ডিস্ট্রিবিউশন কষ্ট ২৪ টাকার পরিবর্তে ৫০ টাকা এবং রিটেইল কস্ট ২৭ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দেন তিনি।

সব মিলিয়ে অপারেটরগুলো বিইআরসির বর্তমান মূল্য উপাদনগুলোর সঙ্গে আরও ২২৪ টাকার বিভিন্ন দায়ভার যোগ করার প্রস্তাব করে।

তবে অবেদনে পর্যাপ্ত কাগজপত্র সংযুক্ত না থাকা এবং দ্বিতীয় দফায় এই ধরনের শুনানিতে আপত্তি থাকায় প্রস্তাবের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যায়নি ক্যাব।

ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণের একটি একটি আইন ও তিনটি প্রবিধি রয়েছে। এগুলো প্রতিপালন করা না গেলে প্রয়োজনে আরেকটা প্রবিধি তৈরি করতে হবে।

দিনব্যাপী শুনানিতে পাল্টাপাল্টি বাক্য বিনিময়, কথার আক্রমণ হয়েছে কয়েক দফাতেই।

এ প্রসঙ্গে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, শুনানিতে অপারেটরদের ভাষার প্রয়োগ শুনে সত্যিই উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে। এরা ভোক্তাদের জিম্মি করতে যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই এদেরকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।

আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, অপারেটররা বারবার মুক্ত বাজারের কথা বলে তাদের কর্তব্য এড়াতে চাইছেন। যেখানে কোনো কিছুই পারফেক্ট নেই, সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। তথ্য উপাত্ত ছাড়া এই শুনানি সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

প্রয়োজনে বিষয়টি প্রতিযোগিতা কমিশনে পাঠাতে হবে তুরিন আফরোজ প্রস্তাব দিলে কমিশন তা আমলে নেন।

উত্তপ্ত সমাপনি পর্ব

দীর্ঘ শুনানির উপসংহারে এসে ভোক্তা প্রতিনিধিদের ওপর ক্ষেপে উঠেন অপারেটরগুলোর প্রতিনিধিরা।

বসুন্ধরা এলপিজির জাকারিয়া জালাল বলেন, শুনানি শুনে মনে হল ২০/২২ জন অপারেটর শুধু ভিন দেশি। আর ওই পাশে যারা আছেন তারা সবাই এই দেশের নাগরিক। আমাদেরকে এভাবে ইগনোর করার চেষ্টা করবেন না।

“আমাদেরকে চোর মনে করলে এ ধরনের শুনানিতে ডাইকেন না। আমরা বিনিয়োগ না করলে আপনার মা-বোনেরা কিভাবে রান্না করতেন? যেই শুনানিতে ব্যবসায়ীদের দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলা হবে সেই শুনানিতে কেন আপনারা আমাদেরকে ডাকেন? আমরা চোর নই, এখানে আমাদের সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। ”

বেক্সিমকোর প্রতিনিধি মুনতাসির আলম শুনানি শেষে আলাপকালে বলেন, শুনানিতে বারবার আদালতের কথা বলা হচ্ছে। আদালতে দাম নির্ধারিত হতে হলে আমরা প্রয়োজনে আদালতে যাব।

ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, লাইসেন্সিদের মধ্যে আমাদের বক্তব্যে কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় উঠে আসেনি। এই পরিস্থিতিতে সমঝোতার একটা পথ আমাদের খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে শুনানির প্রক্রিয়ার বাইরেও আলোচনা হতে পারে। যে প্রশ্নে অপারেটরা ব্যথিত হচ্ছেন সেটা খুবই দুঃখজনক। তাদের সঙ্গে আমাদের খুব একটা দ্বিমত নেই। কিন্তু বিইআরসির পক্ষে আইনি কাঠামোর বাইরেও যাওয়ার সুযোগ নেই।

লাইসেন্সি হিসেবে অটোগ্যাস স্টেশন মালিকদের পৃথক মূল্যহার নির্ধারণের যে প্রস্তাব এসেছে সেটিও ভেবে দেখার কথা বলেন তিনি।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, “আমাদের এলপিজি মার্কেটে মার্জিনাল কস্ট আর মার্জিনাল প্রফিট তো দূরের কথা এখানে মার্জিনাল কস্টে ম্যাস্কিমাম প্রফিট। আমরা সেই তর্কেও যাচ্ছি না।

“রেগুলেটরি কমিশনের কাছে একটি আইন ও তিনটি প্রবিধি আছে। আমরা আইনগতভাবে এর বাইরে গিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। এখানে ৩৪ এর ২ এ আছে ব্যয় সমন্বয় করে মূল্য নির্ধারণ করব, আবার পরের অনুচ্ছেদেই আছে যে ন্যূনতম ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। এর পরে বলা আছে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। কমিশনকে সবগুলো অনুচ্ছেদই দেখতে হয়।”