ই কমার্স: পণ্য কেনার হিড়িকের পর এখন অভিযোগের পাহাড়

আবু বকর সিদ্দিকী ছয় মাস আগে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকায় চারটি মোটর সাইকেল অর্ডার করেছিলেন ই অরেঞ্জে। নানা টালবাহানাও সেই মোটর সাইকেল তিনি পাননি। তাই অভিযোগ জমা দিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। তবে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির মালিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন তিনি শঙ্কিত, তার মোটর সাইকেলটি পাবেন তো?

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2021, 05:44 PM
Updated : 19 August 2021, 05:54 PM

করোনাভাইরাস মহামারীকালে দেশে একের পর এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গজিয়ে ওঠে, তাদের লোভনীয় নানা অফার দেখে পণ্য কিনতে মানুষের হিড়িকও পড়ে। কিন্তু চাহিদার পণ্য না পেয়ে অনেকেই এখন দ্বারস্ত হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ১৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৩ হাজার ৩১৭টা অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে অনেকগুলোর মীমাংসাও করেছেন।

সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আলোচিত ইভ্যালির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠার ৩ বছর না যেতেই তাদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৯৩২টি অভিযোগ জমা পড়েছে।

সম্প্রতি আলোচনায় আসার আগেই ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এরপর কয়েক সপ্তাহে তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে।

বাবুল বলেন, “এখন আমরা হিসাব করার সময় পাচ্ছি না। পুরোনো অভিযোগ সমাধানের পর এগুলো দেখব।”

নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে ১০টি, ফাল্গুনিশপের বিরুদ্ধে ৫৯৯টি (৪৩৫টি মীমাংসিত), প্রিয়শপের বিরুদ্ধে ৫৬২টি (৪১৩টি মীমাংসিত) অভিযোগ এসেছে।

পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দারাজের বিরুদ্ধে ১০১৯টি (৯৪৫টি মীমাংসিত), সহজ ডটকমের বিরুদ্ধে ৯৩টি (৮৫টি মীমাংসিত), আজকের ডিলের বিরুদ্ধে ১৭৭টি (১৬৫টি মীমাংসিত), ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে ২৬১টি (২২৫টি মীমাংসিত), চালডালের বিরুদ্ধে ১৮৩টি (১৬২টি মীমাংসিত) জমা পড়ে অধিদপ্তরে।

অভিযোগগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই নির্ধারিত সময়ের ২/৩ মাস পরও পণ্য বুঝে না পাওয়া নিয়ে। এর বাইরে ‘চেক ডিজঅনার’ হওয়া, ‘রিফান্ডের’ টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো কোনো ক্রেতা ৬৫ লাখ টাকার অর্ডার করেছে বলে আমরা জানতে পারলাম। এক ব্যক্তি সরকারি চাকরি করে পাওয়া পেনশনের সব টাকা ই-অরেঞ্জের পণ্য কেনার জন্য দিয়েছেন।

“কোনো বাইক বা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে প্রতারিত ক্রেতারা ‘বাইক ধরা’ শব্দটি ব্যবহার করছে। এসব কিছু দেখে আমাদের মনে হয়েছে, এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যবসা বা কেনাকাটা নয়। এটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এবং অনৈতিক।”

পণ্য না পেয়ে সম্প্রতি ই অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সামনে বিক্ষোভ করে ভোক্তারা।

দীর্ঘদিন ধরে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা দ্বিগুণ হওয়া এবং সেই টাকা দিয়ে ওয়েবসাইট থেকে কম দামে পণ্য কেনার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে।

এক পর্যায়ে মালিকানা হস্তান্তর করে বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন এই অনলাইন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করেন তাহেরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। আদালতে আত্মসমর্পণের পর মেহেজাবিন ও মাসুকুরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

ই-কমার্সের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ নেওয়ার পর সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য হস্তান্তর করতে হবে।

কিন্তু সেই নীতিমালা উপেক্ষা করে চলতি সপ্তাহের শুরুতে পণ্য সরবরাহে ৪০ দিন সময় নিয়ে ৪৫ শতাংশ মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়ে মোটরসাইকেল বিক্রি শুরু করেছে দালাল প্লাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, “দালাল প্লাস নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। একইভাবে শ্রেষ্ঠ ডটকম, ফাল্গুনীশপ, ধামাকার বিরুদ্ধেও অভিযোগ পাচ্ছি।”

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মেঝেতে-সিঁড়িতে বসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখছিলেন অনেকে।

ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগের পাহাড়

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায়ই ঢাকার কারওয়ান বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে কয়েকশ মানুষের ভিড় জমে যায়। তারা সবাই ই-অরেঞ্জ থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের উপস্থিতিও বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে অধিদপ্তরের নির্ধারিত এলাকা ছাড়িয়ে টিসিবি ভবনের সিঁড়িতে, লিফটে উঠানামা করার খোলা স্থানে বসে অভিযোগ ফরম পূরণ করতে দেখা যায় তাদের।

এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে ই-অরেঞ্জের কাছে প্রতারিত হলেও তারা বিষয়টি অভিযোগ আকারে প্রকাশ করেননি। ঈদের আগে লকডাউন দেওয়ার পর আর যোগাযোগ করা যায়নি ই-অরেঞ্জের সঙ্গে। এখন মালিক গ্রেপ্তার হওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন।

যেসব অভিযোগকারী এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশের বয়সই ২০ বছর থেকে ৩০ বছর। তারা প্রায় সবাই মোটর সাইকেল কেনার অর্ডার দিয়েছিলেন।

মোস্তফা কামাল নামে একজন ক্রেতা বলেন, গত জুন মাসে তিনি ৮৫ হাজার টাকায় ভাউচার কিনে ১৫০০ সিসি পালসার বাইকের অর্ডার করেছিলেন। ২৫ দিনের মধ্যে বাইক বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা আর পাননি।

গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা পেয়ে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পেন্ডিং, কনফার্ম, প্রসেসিং, পিকড, শিপড, ডেলিভার ও রিসিভড ইত্যাদি নানা স্তর সাজিয়ে সময় ক্ষেপনের ব্যবস্থা রেখেছে ইভ্যালি।

এর মধ্যে ‘পিকড’ এর মানে হচ্ছে বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্যটি ইভ্যালি গ্রহণ করেছে, এখন শুধু ডেলিভারি দেওয়ার প্রক্রিয়া বাকি।

বাপ্পী নামের একজন ইভ্যালি গ্রাহক বলেন, “গত জুন থেকে আমার পণ্য পিকড হয়ে আছে। এখনও বুঝে পাইনি। দুটি মোটর সাইকেলের তালা অর্ডার করেছিলাম। এগুলো আর পাব বলে মনে হচ্ছে না।”

লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন ইভ্যালি থেকে ১০ লাখ টাকার পণ্য কেনার পর আরও কিনতে প্রলুব্ধ হন। তিনটি আইডি তৈরি করে ইভ্যালির নিয়মিত ক্রেতা বনে গিয়েছিলেন তিনি।

এরপর নিজের ১০ লাখ টাকা এবং আত্মীয়-স্বজন থেকে আরও ২০ লাখ টাকা নিয়ে মোট ৩০ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করেন তিনি।

কিন্তু মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের ৭০টি অর্ডার এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নাসিরের। তাই অভিযোগ নিয়ে এসেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

ই-ভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের মোবাইল নম্বরটি বেশ কিছু দিন ধরে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তবে তিনি সম্প্রতি বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে গ্রাহকদের পণ্য বুঝিয়ে দিতে পারবেন বলে তারা আশাবাদী।

ই-অরেঞ্জের সাবেক ও বর্তমান মালিকরা গ্রেপ্তার আছেন। ধামাকা ও ফাল্গুনী শপের মালিকদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারাও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে আছেন বলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

পণ্য না পেয়ে সম্প্রতি ই অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সামনে বিক্ষোভ করে ভোক্তারা।

প্রতিকার কী?

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের সমাধান কীভাবে হচ্ছে- প্রশ্নে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু সাহা বলেন, “আমরা আমাদের সামান্য লোকবল নিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।

“যেসব প্রতিষ্ঠানের অফিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা অফিস বন্ধ করে মালিকরা আত্মগোপনে কিংবা মালিকরা আইনি প্রক্রিয়ার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে তো কোনো বিচারিক কাজ চালানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।”

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ই-কমার্সগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হলেও এগুলো দেখভাল করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

“সম্প্রতি যে অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ হচ্ছে তা প্রতিরোধে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় থাকলে সেটা করা হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক সংগঠন হিসাবে ই-ক্যাবেরও কিছু করণীয় আছে। আমার ধারণা তারা কাজ করছে।”

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ইক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই ১৬টা কোম্পানিকে নোটিস দিয়েছি বিভিন্ন অভিযোগ পেয়ে। তাদের অধিকাংশই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। অচিরেই ৮/১০টি কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করব আমরা।”

তিনি বলেন, ইভ্যালি একটি ‘ভুল মডেল’ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে এবং তা দেখে গত ছয় মাসে আরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান সেই পথ ধরায় এধরনের আর্থিক জটিলতা তৈরি হয়েছে।

তমাল বলেন, “এখানে অধিকাংশ টাকাই ভুল প্রক্রিয়ায় মাঠে বিতরণ করা হয়েছে। ফলে এই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। আরও দেড় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষক ও দুইজন আইনজীবী দিয়ে আমরা রিভিউ করে দেখেছি এই বিজনেস মডেলটা ভুল। এভাবে কখনও লাভ করা যাবে না। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি।”

এই পরিস্থিতিতে অ্যাসোসিয়েশনের পদক্ষেপ কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আমাদের প্রচেষ্টায় নীতিমালাটা কার্যকর করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এটা আরও আগে করতে পারলে আরও ভালো হত। এই নীতিমালা আসার কারণেই ভুল আর অনিয়মগুলো ধরা পড়েছে। এখন যাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই সরকারের উচিৎ তাদেরকে বন্ধ করে দেওয়া।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর তারা সতর্ক করছেন তাতে কাজ না হলে কঠিন ব্যবস্থা নেবেন।

পণ্য যারা কিনছেন, তাদের সচেতন হওয়ার উপরও জোর দেন তিনি।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলুও একই কথা বলেন।

তিনি বলেন, “একজন ক্রেতা ২০০ ক্যান সরিষার তেলের অর্ডার করে বসে আছেন। এক ট্রাক কোকাকোলা অর্ডার করার কথা শুনতে পারছি। তাহলে এদের ভোক্তা হিসাবে বিবেচনা করব? নাকি ব্যবসায়ী হিসাবে বিবেচনা করব?”

“জেনে-বুঝে নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হবে। এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের ভোক্তাদের আচরণ অস্বাভাবিক। তবুও আমরা চেষ্টা করি ভোক্তাদের অধিকার আদায় করে দিতে,” বলেন তিনি।