তাহলে চালের বাজার এতো চড়া কেন তার যথার্থ উত্তর মিলছে না। এর পেছনে ‘কারসাজি’ রয়েছে বলে কেউ কেউ সন্দেহ করলেও তার স্পষ্ট কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
ঈদের আগে মিল গেইটে দাম বেড়েছে বলে ঢাকার বিক্রেতারা দাবি করেছেন; কিন্তু চালকল মালিকরা তা অস্বীকার করছেন।
উল্টো দাম বৃদ্ধির পেছনে ঢাকার পাইকারদের ‘কারসাজি’ থাকতে পারে বলে চালকল মালিকদের একজন নেতা দাবি করেছেন।
দেশে খাদ্যের মজুদ গড়তে সরকার নিয়মিত ধান-চাল সংগ্রহ করলেও বাজারের উপর কার্যকর নজরদারি নেই। ফলে কেন দাম বাড়ছে সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যও মিলছে না।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ অটোমেজর হাস্কিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিল গেইটে চালের দাম বৃদ্ধির খবর একেবারেই ‘ভিত্তিহীন’। তার ভাষায়, অধিকাংশ মিল এখনও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪০ টাকা কেজি দরে সরকারি গুদামে চাল দেওয়ায় ব্যস্ত।
ঢাকার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা কাদের কাছ থেকে চাল কেনেন তা নিয়ে অনুসন্ধান চালালে ‘কারসাজির’ উৎস মিলবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রায় এক মাস ধরে ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ৫০ টাকা বা এর আশপাশে বিক্রি হচ্ছে মোটা চাল। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা থেকে ৬৮ টাকায়।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসেবে, ঢাকার কাঁচা বাজারগুলোতে গতবছর এ সময় মোটা চাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং সরু চাল ৫০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
একবছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ৭ টাকা ও সরু চালের দাম ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে; বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১৬ শতাংশ ও ১৪ শতাংশের বেশি।
টিসিবি বলছে, শুক্রবার ঢাকায় প্রতি কেজি মোটা চাল (স্বর্ণা/চায়না ইরি) মানভেদে ৪৭ থেকে ৫২ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছিল। আর সরু চাল (নাজিরশাইল/মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৬০ থেকে ৬৮ টাকায়।
তবে বাস্তবে রাজধানীবাসী এই দরে চাল কিনতে পারছে না। কাঁচাবাজার ও অলিগলির দোকানগুলোতে এর চেয়ে বেশি দরেই চাল বিক্রি হচ্ছে।
মিরপুরের পীরেরবাগ মায়ের দোয়া বিপণী বিতানের ফেরদৌস হাসান জানান, তার দোকানে গুটি স্বর্ণা, পাইজাম ও বিআর আটাশ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট মানভেদে ৬০ টাকা থেকে ৬৪ টাকা, কাটারি মিনিকেট ৬৫ টাকা, মাঝারি মানের নাজিরশাইল ৭০ টাকা ও বাসমতি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অথচ মিলাররা বলছেন, তারা ৫২ টাকা কেজি দরে সরু চাল এবং ৪১ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রতি বস্তায় ২০০ টাকা বাড়িয়ে মিনিকেট এখন দুই হাজার ৯০০ টাকায় এবং পাইজাম দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। আর দেড়শ টাকা বাড়িয়ে বিআর আটাশ দুই হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।
মহিউদ্দিন হারুন নামে ঢাকার আরেক পাইকার জানালেন, ঢাকার পাইকারি বাজারে এখন মিনিকেট চাল ৫০ কেজির বস্তা দুই হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৯৫০ টাকা, গুটি স্বর্ণা চাল দুই হাজার ১৫০ টাকা, পাইজাম দুই হাজার ৩০০ টাকা, বিআর আটাশ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে লায়েক আলী বলেন, মিল পর্যায়ে এখন মোটা চাল প্রতি কেজি ৪১ টাকা, সরু চাল ৫২ টাকার মধ্যে রয়েছে।
“কুষ্টিয়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট গেলে এই দামে অহরহ চাল পাওয়া যাবে, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি।”
মিল মালিকদের এই নেতার হিসাবে, মিল গেইটে বস্তাপ্রতি মোটা চালের দাম দুই হাজার ৫০ টাকা ও সরু চালের দাম দুই হাজার ৬০০ টাকা পড়ে।
পাইকাররা যে দাম বলছেন, তার সঙ্গে এই দামের ফারাক মোটা চালের বস্তাপ্রতি অন্তত ৪০০ টাকা এবং সরু চালের ক্ষেত্রে অন্তত ৩০০ টাকা।
লায়েক আলী বলছেন, ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ কেনার তথ্য সংগ্রহ করে তা খতিয়ে দেখলেই ‘বিশাল এই ফারাকের কারণ বের হবে।
খুচরায় চালের চড়া দরের জন্য মিলাররা ‘মোটেও দায়ী নয়’ দাবি করে তিনি বলেন, “কেউ যদি মনে করে মিলাররা উচ্চ দামে চাল বিক্রি করছে, তিনি তাহলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারেন। দামে কীভাবে এত পার্থক্য হয় সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুঁজে বের করুক।”
এই চালকল মালিক বলেন, এক মাসের ব্যবধানে ধানের দাম মণপ্রতি অন্তত ৭০ টাকা কমে এখন ১২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেসব মিলে দিনে ৩০ ট্রাক চাল বিক্রি হত, সেখানে এখন ১০-১২ গাড়িও বিক্রি হচ্ছে না। তাহলে মিল গেইটে দাম বাড়ানোর যুক্তি থাকতে পারে না।
“আমরা প্রতি ১৫ দিন পর পর ধান কেনা, চাল বিক্রি ও মজুদের তথ্য সরকারকে দিচ্ছি। তারপরেও বাজারে এই অস্থিতিশীলতার জন্য কারা দায়ী সেটা খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
বিভিন্ন সময় সরকারি মজুদ কমে যাওয়ার কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলেও এবারের পরিস্থিতি তার থেকেও ব্যতিক্রম। কারণ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন ১৬ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে চালের মজুদ রয়েছে ১৩ লাখ টন।
“এসব কারণে এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ বাকি রয়ে গেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। আমরা বিদেশ থেকে চাল আমদানি অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে যেন চাল আমদানি করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছি।”
তিনি জানান, চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে একাধিকবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, মিলারদের সঙ্গে, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
“মিল গেইটে কম, আবার খুচরায় বেশি- এ বিষয়টি দেখভালের জন্য আমরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে নানাভাবে বলেছি। জুলাই মাসের শুরুতে তাদেরকে নিয়ে একবার বসেছিলাম, জুলাই মাসের শেষের দিকেও আবার বসেছিলাম।”
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চালের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আমরা অভিযান পরিচালনা করার পর গত এক মাসে চালের দাম আর বাড়েনি।
তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এ ধরনের অভিযান চালিয়ে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না বলে মন্তব্য করেন সরকারের এই কর্মকর্তা।
বাজার নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মত মিল থেকে কী দামে, কোন ব্যবসায়ীর কাছে কত পরিমাণ চাল হস্তান্তর হয় সেই তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে অভিযান চালিয়ে ভুয়া দাম ঘোষণাকারী ও কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
“দ্বিতীয়ত, চালের উৎপাদন নিয়ে সরকারিভাবে কৃষি বিভাগ যে তথ্য প্রকাশ করে, তা আরেকটু পর্যালোচনা করতে হবে। আমাদের দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ যে পরিমাণ উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে কম উৎপান হচ্ছে বলেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তৃতীয়ত চাল আমদানির পথ সুগম করলে এসব অতি মুনাফার কারবার নিজ থেকে দমন হয়ে যাবে।”
বাজার সহনীয় করতে সরকার বৃহস্পতিবার চালের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। এখন চাল আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানি করা যাবে।