লালবাগের পোস্তা কেন্দ্রিক কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের চাহিদা কম থাকলে বাজারে দামও পড়ে যায়। তাছাড়া ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পাওনার পুরোটা শোধ না করায় পাইকারদের আর্থিক সঙ্কট পুরোপুরি কাটেনি, ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেননি।
অন্যদিকে ট্যানারি শিল্প মালিকরা বলছেন, পাওনা পরিশোধ নিয়ে আড়তদারদের দাবি পুরোপুরি সঠিক নয়, মূল সঙ্কট রপ্তানিতে। হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তরের সময় ‘চরম অব্যবস্থাপনার কারণে’ বিদেশি ক্রেতা চলে যাওয়ায় তাদের রপ্তানি কমেছে। এর মধ্যে মহামারীর চক্করে সেই সঙ্কট আর কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে।
সব পক্ষের মত নিয়ে সরকার এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ টাকা থেকে ৩৭ টাকায় বেঁধে দিয়েছিল। আর সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
দেশে দুবছর ধরে চলছে করোনাভাইরাস মহামারী; চাহিদা কমে যাওয়ায় আগের বছরের মজুদ রয়ে গিয়েছিল গতবছর, পাশাপাশি অর্থ সঙ্কটে চামড়া সংগ্রহেও ছিল ভাটা। ফলে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের।
নামমাত্র দামও না মেলায় দেশজুড়ে চামড়া ফেলে দেওয়ার বহু ঘটনায় গত দুবছর ঈদ উৎসবের সময় আলোচনা-সমালোচনা ছিল ব্যাপক।
তবে এবার ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়তদারদের বকেয়া কমে এসেছে। পুরনো মজুদ কমে আসায় চাহিদাও বাড়বে বলে আশা হচ্ছিল। ফলে এবার ঈদে চামড়া সংগ্রহে ‘দুঃসময়’ কাটবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু তারপরও ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে পুরান ঢাকার পোস্তা ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আশেপাশের বেশ কিছু আড়তের সামনের সড়কে শত শত চামড়া পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সেগুলো বর্জ্য হিসেবে সরিয়ে নেন।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল, আড়তদাররা তাদের কেনা দামও দিতে চাননি। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রেখে দরদাম চালিয়ে গেলেও শেষ সময়ে ‘পচে যাওয়ার’ অজুহাতে আড়ত বন্ধ করে তারা চলে যান। এ অবস্থায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের সারা বছর চামড়া সরবরাহ করলেও বছর শেষে তারা পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় এই সঙ্কট তৈরির হয়েছে।
“এবছর নতুন লেনদেনের টাকা পরিশোধ করায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ট্যানারি মালিকরা এখনও পুরনো টাকা পরিশোধ করছেন না।”
তবে গত দুই বছরের চেয়ে এবার চামড়া সংগ্রহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চামড়া নষ্ট হওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল ২০১৯ সালের কোরবানির সময়। ২০২০ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। এবার চামড়া সংগ্রহ ও দামে অনেক উন্নতি হয়েছে।”
অতিরিক্ত গরমের কারণে কিছু চামড়া সবসময়ই নষ্ট হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গতবার বেশি চামড়া নষ্ট হয়েছিল সিলেট ও চট্টগ্রামে। এবার আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার কারণে ওই এলাকার চামড়াও নষ্ট হয়নি।”
পরিস্থিতির উন্নতি হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ কেন করছেন- এ প্রশ্নে আফতাব খান বলেন, “আমরা এই চামড়া বিক্রি করি ট্যানারি শিল্প মালিকদের কাছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের রপ্তানি আদেশ কমে গেলে তারা চামড়া কেনেন না। এর ফলে দামও কমে যায়।”
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে যেখানে প্রায় ১০২ কোটি ডলার আয় করেছিল, পরের অর্থবছরে তা ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে যায়।
তবে সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতে আয় বেড়ে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার হয়েছে। এই অংক আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি এবং লক্ষ্যমাত্রার ৯২ কোটি ডলারের তুলনায় ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহও রপ্তানি পরিস্থিতিকে সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে দেখালেন। তবে আড়তদারদের পাওনা টাকার বিষয়ে তার ভাষ্য ভিন্ন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেন, “কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা যে দাবি করছেন তারা আমাদের কাছে টাকা পাবেন, এটা পুরো ঠিক নয়। গত বছর এবং তার আগের বছরসহ কয়েক বছরের পাওনা টাকা আমরা দিয়ে দিয়েছি।তবে পুরনো কিছু টাকা পাবে।
“তাদের সাথে আমাদের অনেক বছর ধরেই ব্যবসা চলে আসছে। এই চলমান প্রক্রিয়ায় কিছু টাকা থাকতে পারে। এই পুরনো টাকার জন্য তারা আর্থিক সংকটে পড়বে- এটা ঠিক নয়।”
ঈদের আগে এই ‘পুরনো গল্প শুনিয়ে’ পাইকাররা ‘কম দামে চামড়া কেনার ব্যবস্থা করেন’ বলে মন্তব্য করেন সাখাওয়াত উল্লাহ।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে হাজারীবাগের ২২৫টি ট্যানারি কারখানা একদিনে বন্ধ করে দেওয়ার পর নামি দামি বিদেশি ক্রেতাদের অধিকাংশই ‘চলে গেছে’। মূলত এরপর থেকেই সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে এ শিল্প।
“এমন পরিস্থিতিতে আমরা উৎপাদনে যেতে না পারায় ইউরোপ-আমেরিকা ভিত্তিক ক্রেতারা চলে গেছে।”
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, তারা চীনের সঙ্গে সরাসরি কাঁচা চামড়া রপ্তানির ব্যবসা করি। চীনারা প্রতি বর্গফুট চামড়ায় দাম দেয় ৪৫ সেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১ ডলার। এমন পরিস্থিতিতে দেশে চামড়া শিল্পে ‘শনির দশা’ ভর করেছে।
তবে এ বছর থেকে পরিস্থিতির ‘কিছুটা উন্নতি’ হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বেশ কিছু দেশ থেকে আমরা অর্ডার পাচ্ছি। আগামী বছর থেকে আরও বেশি অর্ডার আসতে শুরু করবে বলে আমরা আশা করছি।”
আর করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে গেলে চামড়ার ব্যবসাও আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে এই ট্যানারি মালিক বলেন, “এশিয়ায় মহামারী বাড়লেও ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে কোভিডের তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। ওই সব এলাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করায় পোশাক, ফ্যাশনপণ্যের সাথে সাথে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে।”