কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এবার সামান্য বাড়ল

ঈদ সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; পশু ও আকারভেদে এবার চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে সামান্য বেড়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2021, 08:02 AM
Updated : 15 July 2021, 09:21 AM

ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া কিনতে হবে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।

ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়ার দাম হবে ৩৩ টাকা থেকে ৩৭ টাকা, গতবছর যা ২৮ থেকে ৩২ টাকা ছিল।

এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গতবছর খাসির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকায় বেঁধে দিয়েছিল সরকার।

বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আয়োজিত আলোচনা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দাম ঘোষণা করেন।

সরকারের এই প্রস্তাবে চামড়া খাতের সব স্তরের ব্যবসায়ীরা একমত পোষণ করেছেন, সম্ভব হলে কিছু ক্ষেত্রে আরও ভালো দাম দেবেন বলে তারা আশ্বাসও দিয়েছেন।

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ বছর ঢাকার ভেতরে গরুর চামড়ার দাম ২০১৮ সালের মত ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলেন।

কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে গতবছরের চেয়ে প্রতিবর্গফুটে ৫ টাকা বাড়ানোর কথা বলেন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সেই প্রস্তাবই গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, “আপনাদের প্রস্তাবই মেনে নিলাম। তবে আল্লাহর ওয়াস্তে যা বলেছেন সেটা যেন বাস্তবায়ন করেন। আপনারা মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে চামড়ার দাম বেঁধে দেওয়ার বিরোধিতা করছেন; সেটাও ঠিক আছে। সম্ভব হলে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনে সেটা প্রমাণ করে দেখান। এতে সরকারের বদনাম হলে হোক।”

এ বছর লবণ ছাড়া চামড়ার দাম নিয়ে আলোচনা হয়নি। বরং কোরবানিদাতা হতে শুরু করে মসজিদ ও এতিমখানা যেখানে চামড়া মজুদ করা হয়, সেখান থেকেই চামড়ায় লবণ দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

গরমের মওসুমে আদ্রতা ও তাপমাত্রা বিবেচনায় চামড়ার সঠিক মান ধরে রাখতে কোরবানির চার ঘণ্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “কোরবানির দিন চামড়া সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস মতে কোরবানির আগে পরে তিনচার দিন আর্দ্রতা থাকবে ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ। তাপমাত্রা থাকবে ৩২ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অবস্থায় চামড়া সংরক্ষণ করা চ্যালেঞ্জিং হবে।

“যেহেতু মাত্র ৮২ হাজার টন লবণ লাগবে। এই লবণগুলো মসজিদগুলোতে বণ্টন করতে সরকারের মাত্র ৯ কোটি টাকা লগবে। এটা করা গেলে চামড়া সংরক্ষণটা খুব কার্যকর হবে।”

বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে।

পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।

প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানিতে এক কোটি ১৮ লাখ পশু কোরবানির যোগ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে গরু-মহিষ ৪৫ লাখ এবং ছাগল ভেড়া ৭২ লাখ।

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী আফতাব খান সভায় বলেন, “গতবছর বেশি দাম পাওয়ার জন্য ঢাকার ভেতরে চামড়া নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছিল। শৃঙ্খলার জন্য এটি রোধ করতে হবে। গত বছর সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে দাম না পেয়ে কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছিল। এবার সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।”

চামড়া খাতের ব্যবসায়ী নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, “কোরবানির চার ঘণ্টার মধ্যে যেন কোরবানিদাতা চামড়ায় লবণ দিয়ে দেন সেজন্য প্রচার চালাতে হবে। তাহলে চামড়া সহজে নষ্ট হবে না। চামড়া নিয়ে হাহুতাশ কিছুটা হলেও কমবে।”

দুবছর ধরে চলছে করোনাভাইরাস মহামারী; চাহিদা কমে যাওয়ায় আগের বছরের মজুদ রয়ে গিয়েছিল গতবছর, পাশাপাশি অর্থ সঙ্কটে চামড়া সংগ্রহেও ছিল ভাটা। ফলে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের।

নামমাত্র দামও না মেলায় দেশজুড়ে চামড়া ফেলে দেওয়ার বহু ঘটনায় গত দুবছর ঈদ উৎসবের সময় আলোচনা-সমালোচনা ছিল ব্যাপক।

তবে এবার ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়তদারদের বকেয়া কমে এসেছে। পুরনো মজুদ কমে আসায় চাহিদাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির পথ সুগম হওয়ায় এবার ঈদে চামড়া সংগ্রহে ‘দুঃসময়’ কাটবে বলে আশা করছেন এ খাতের অনেকে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আরও কিছু সহায়তা চাইছেন তারা।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, “গত বছর সর্বমোট ৬৫ কোটি টাকার নতুন লোন পেয়েছিলাম, এটা আমাদের জন্য অপ্রতুল। ৫৮৫ কোটি টাকার যে লোন অনুমোদন করা হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই গেছে পুরোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে। পুরোনো লোনগুলো ব্লক করে নতুন করে লোন দেওয়ার অনুরোধ করছি।

“পাশাপাশি হাইড অ্যান্ড মার্চেন্ট ব্যবসায়ীদেরকেও ঋণের আওতায় আনা উচিত। যাতে মাঠে চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়।”

শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা, ধর্ম সচিব নুরুল ইসলাম, তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব দীপক চক্রবর্তী, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফেরদৌস আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এএসএম নাসের, অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল্যাহ হারুন পাশা, এনএসআই প্রতিনিধি, লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবিরসহ সংশ্লিষ্টখাতের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা অনুষ্ঠানে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।