কোরবানির গরু: কোভিড সতর্কতায় খামারিদের পোয়াবারো

হাতিরঝিল লাগোয়া সামারাই ক্যাটেল ফার্মের ৩০০টি গরুর ৯৫ শতাংশই বিক্রি শেষ, যেগুলো ক্রেতারা কিনেছেন ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকা দামে আর এরমধ্যে অনলাইনেই অর্ডার ছিল ৬০ শতাংশের।  

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2021, 06:03 PM
Updated : 15 July 2021, 06:03 PM

রাজধানী ঢাকার এই খামারের মত পরিচিত ও নামি অনেক খামারের কোরবানির গরু বিক্রির চিত্র মোটামুটি কাছাকাছিই।

মহানগর প্রজেক্ট এলাকার এই খামারের ব্যবস্থাপক মো. সাহেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত মাস থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে। এখন হাতেগোনা কয়েকটি গরু আছে, সব তো বিক্রিই হয়ে গেছে।”

দাম নির্ধারণের বিষয়ে তিনি বলেন, “১০০ থেকে ৩০০ কেজি ওজনের গরু ৪২৫ টাকা কেজি হিসাব ধরে বিক্রি হয়েছে। ৩০০ কেজির বেশি গরুগুলো চোখের দেখা অনুযায়ী ক্রেতারা নিয়েছেন।“

গত বছর অনলাইনে ২০ শতাংশের মত গরু বিক্রি হয়েছিল বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের অতি বিস্তার রোধে দেশে কঠোর লকডাউন শুরু হলে হাটের অপেক্ষায় না থেকে অনেকেই এভাবে খামার থেকে কোরবানির পশু কিনছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে ঢাকার নামিদামি খামারের বেশিরভাগ গরু বিক্রি হয়ে গেছে। তবে কম পরিচিত ও নতুন খামারে বছরজুড়ে লালনপালন করা সব গরু এই ঈদে বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে নিজেদের শঙ্কার কথা বলেছেন বহু খামারি।

মঙ্গলবার হাতিরঝিল লাগায়ো সামারাই ক্যাটেল ফার্ম থেকে তোলা।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে হাটে গিয়ে পশু কেনা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে খামারকে ভালো বিকল্প বলছেন ক্রেতারা। এছাড়া তারা মনে করছেন, রাজধানীতে কোরবানির আগে নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে খামার থেকে পশু পাওয়াটা তাদের বাড়তি সুবিধা দেবে।

বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ক্রেতাদের কেউ কেউ অনলাইনে ছবি দেখে, তারপর খামারে এসে পছন্দ করে কিনছেন। আবার কেউ অনলাইনে সরাসরি দেখেও কিনেছেন। অনলাইনে এবার বেশি সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তারা।

বড় গরুর তুলনায় ছোট আকারের গরুর চাহিদা কিছুটা বেশি বলে একাধিক খামারি জানিয়েছেন।

তবে এবার গত বছরের তুলনায় খামারে গরুর দাম কিছুটা বেশি বলে মনে করছেন ক্রেতারা। ১০০ থেকে ৩০০ কিংবা ৪০০ কেজি ওজনের গরু ৪২৫ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি ধরে হিসাব করে মূল্য নির্ধারণ করছেন খামারিরা। এর চেয়ে বেশি ওজনের গরুর দর ঠিক হচ্ছে ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে।

দাম ‘কিছুটা বেশি’ হওয়ার বিষয়ে বিক্রেতারা গো খাদ্যের বাড়তি দামসহ খামারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন।

গরুর দাম-দরের বিষয়ে ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা সামারাই ক্যাটেল ফার্মের ব্যবস্থাপক সাহেদ আরও বলেন, “আমরা একটি গরু এক বছর থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত লালন-পালন করে থাকি। এরপর কোরবানির উপযোগী করে বিক্রি করে থাকি।

“এ বছর গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি গরুর পেছনে ব্যয়ও অনেক বেড়েছে, যে কারণে অন্য বছরগুলোর তুলনায় দাম একটু বেশিই বলা যায়।”

মঙ্গলবার হাতিরঝিল লাগায়ো সামারাই ক্যাটেল ফার্ম থেকে তোলা।

এই খামারে গরু কিনতে আসা মগবাজারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, “গত কয়েক দিনে মোহাম্মদপুরের সাদেক এগ্রো, এস এ করপোরেশন, আল মদিনা এগ্রো ফার্মে গিয়ে কিছু গরু দাম-দর করে এসেছি, সেখানে দেখলাম লাইভওয়েটে গরু বিক্রি হচ্ছে। দাম একটু বেশিই মনে হয়েছে।”

মঙ্গলবার মহানগর প্রজেক্টের এই খামারে এসেও গরু পছন্দ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই খামারে তো বাকি কোনো গরুই নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। আমার পছন্দ মাঝারি গরু, তা নেই।”

খামার থেকে কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, “এবার করোনার ঝামেলা তো আছেই, বাজারে তো ভিড় হবেই।

“এছাড়া শহরের ভেতরে খামার বলে দাম একটু বেশি হলেও সেখান থেকে নিলে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। এরা ঈদের দিন সকালে বা আগের দিন বাসায় দিয়ে আসবে। শহরের ফ্ল্যাট বাসাতে থেকে একটা পশু দুই-তিন দিন কোথায় রাখা হবে সেটা একটা ঝামেলা মনে হয়, সেকারণে খামার থেকে কেনার ইচ্ছা।”

নগরীর সবেচেয়ে বড় খামার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার সাদেক এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান হোসেন জানান, তাদের খামারে ঈদের জন্য দুই হাজার ২০০টি গরুর মধ্যে ইতোমধ্যে এক হাজার ৩০০টি বিক্রি হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার অনলাইন বিক্রি বেড়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এবার ছোট সাইজের গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। অথচ বড় গরুতে ব্যয় অনেক বেশি। সেগুলো যদি ঈদে বিক্রি করা সম্ভব না হয় তাহলে খামারের জন্য একটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

খিলগাঁও নন্দীপাড়ার আব্দুল মালেক এগ্রো ফার্মের ব্যবস্থাপক কাজী ফেরদাউস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের একটা ফেইসবুক পেইজ আছে। ক্রেতা ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে পছন্দ করলে তাদেরকে খামারে আসতে বলি। এরপর যারা আসছেন তাদের সরাসরি দেখে কথা বলে ফাইনাল করে থাকি।”

তারাও কেজিপ্রতি এবং আকার অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “লাইভওয়েটে আমরা কেজি প্রতি ৪৩০ টাকা হিসাবে দাম চাচ্ছি। তবে ৪২৫ টাকায় বিক্রি করছি।”

গোখাদ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিই গরুর দাম বাড়িয়েছে বলে জানান এই খামারিও।

তাদের সংগ্রহে ১২০টি গরু রয়েছে জানিয়ে ফেরদাউস বলেন, “ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি বিক্রি হয়েছে। ঈদের আগেভাগে বিক্রি শেষ হবে কিনা তা তো একটা শঙ্কা কাজ করছেই।”

এই খামারের একটু দূরে মেরাদিয়া এলাকার রয়েল রেঞ্চ অ্যান্ড ডেইরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ মুহাম্মদ সানী জানান, তারা ৩০০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। এরমধ্যে অন্তত ২০০টি বিক্রি করতে চান।

“বহু মানুষ ফেইসবুকে দেখে খামারে আসছেন, পছন্দ করে বুকিংও দিচ্ছেন। ৮০টির মত গরু ইতোমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে।“

ঢাকার শ্যামপুরের মাকসুদা ডেইরি অ্যান্ড এগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইরফান দেওয়ান বলেন, “আমাদের ছোট একটি খামার, কোরবানি উপলক্ষে হাতেগোনা কিছু গরু থাকে, সেগুলো ইতোমধ্যে বিক্রিও হয়ে গেছে।”

মঙ্গলবার হাতিরঝিল লাগায়ো সামারাই ক্যাটেল ফার্ম থেকে তোলা।

তবে পশু খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদেক এগ্রো ফার্মের মালিক ইরমান হোসেনের আশঙ্কা, গত বছর ৯৯ লাখ পশু কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও তা পূরণ সম্ভব হবে না।

“এর কারণ হিসেবে ঈদের কাছাকাছি সময়ে সারাদেশে লকডাউন থাকার পাশাপাশি শহরগুলোর বিভিন্ন ফ্ল্যাট মালিকদের করোনা পরিস্থিতিতে এক ধরণের নিরুৎসাহিত করার মত কারণও রয়েছে।

“সর্বোপরি করোনাভাইরাসে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার থাকায় অনেকে আর্থিক সংকটও আছেন।”

প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. দেবাশীষ দাশ এবার কোরবানিতে এক কোটি ১৯ লাখ পশু প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের মন্ত্রী মহোদয় আজ (বুধবার) এক মিটিংয়ে বলেছেন- পুরো বিক্রিটাই যেন অনলাইনে সম্পন্ন করতে পারি। তা না হলেও আমাদের সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ পশু এবার অনলাইনে বিক্রি হবে।”

সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এক হাজার ৭৭৮টি অনলাইন প্লাটফর্মে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক লাখ ৮৪ হাজার ৮৯৬টি পশু বিক্রি হয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “এর মধ্যে আগের বছরের মত সবচেয়ে বেশি পশু বিক্রি হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে (এক লাখ ১৫ হাজার ৬৭৫টি)।“

অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা জানান, দেশে ছোট-বড় মিলে ছয় লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি পশুর খামার রয়েছে। এর মধ্য ঢাকা বিভাগে আছে ৯২ হাজার ৮২১টি এবং জেলায় চার হাজার ৭১৯টি।

আরও পড়ুন