টিসিবি-ওএমএসের পণ্য: রামপুরায় ফরিদারা ফিরছেন ‘ভগ্ন মনে’

বাসায় কাজ করার পাশাপাশি বিকালে হাতির ঝিলে পানি বিক্রি করতেন রামপুরার উলন রোডের ফরিদা বেগম। এখন কোনো কাজই নেই। নিয়মিত খাবারের টাকাই জোটে না বলে ভাড়াও দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা তাই বাসা ছাড়তে বলেছেন।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2021, 04:25 PM
Updated : 11 July 2021, 05:42 PM

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে লকডাউনে আয়ের পথ বন্ধ হলে অর্থের টানাটানিতে স্বামী পরিত্যক্ত এই নারী ও তার দুই সন্তানের দিন যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। তিনদিন ধরে কিছু টাকা জোগাড় করে কম দামে কিছু পণ্য কিনতে দাঁড়াচ্ছেন টিসিবির ট্রাকের লাইনে।

আগের দুদিন শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছু পাননি। রোববার ট্রাকই আসেনি। এতে হতাশাই যেন পেয়ে বসে তাকে। মলিন মুখে ফিরে যাওয়ার সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদককে এক নাগাড়ে বলে ফেললেন অনেক কথা; নিজের দু:খের কথা শোনার কাউকে পেয়ে হয়ত কিছুটা স্বস্তিই পেলেন।

তিনি বলেন, “তিন দিন ধরে আইতেছি কিন্তু পাই না। আগের মানুষদের ৪ থেকে ৫ লিটার করে তেল দিয়া দেয়, আমাদের দেয় না। পরে আরও গাড়ি আসবে বলে হেরা চলে যায়। কিন্তু পরে আর গাড়ি আসে না, বিকেল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেছি।

রোববার রামপুরা বাজারের কাছে ওএমএসের চাল-আটা কিনতে মাকে নিয়ে এসে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকা মনি বেগম ট্রাকের দেখা পাননি।

“এখন কী করে খামু। ছুডু একটা টিনের ঘরে থাকি। বাড়িওয়ালা এহন ঘরে তালা মারবো কইতাছে। বারে বারে আহে ঘরভাড়া লইতো। ঘর ভাড়া দিতারি না, খাইতে পারি না।

“বড় ছেলে ১০ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসারে থাকেন। তৃতীয় ছেলে প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে ১০ বছরের শিশু। ক্যামনে যে চলছে।“

ফরিদা জানান, স্বামী বৃদ্ধ বয়সে সহায়-সম্বলহীন হয়েও আরেকটি বিয়ে করে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া গ্রামের বাড়ি চলে গেলে বিপদ আরও বাড়ে তাদের।

রোববার রাজধানীর রামপুরার যে এলাকায় নিয়মিত ‘ন্যায্য মূল্যে’ টিসিবি ও ওএমএসের পণ্য বিক্রি করা হয়, সেখানে শুধু ফরিদা নয়- তার মত আরও অনেককেই হতবিহ্বল হয়ে খালি হাতে চলে যেতে দেখা গেল।

রামপুরা বাজার এলাকার ব্র্যাক ব্যাংকের উল্টোপাশে থাকা নিম্নআয়ের কয়কেশ নারী-পুরুষকে ট্রাক আসবে না বলে সকাল সাড়ে ১০টায় একদল পুলিশ সরে যেতে বললে সবাই নিরবেই চলে যান। সচরাচর প্রতিদিন এই এলাকায় টিসিবির ট্রাক থামে।

তবে ওই এলাকা থেকে লোকজন চলে গেলে বেলা ১১টার পর কয়েকশ গজ দূরে রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনের সড়কে টিসিবির ট্রাক এসে থামে, সেখানেও শত শত মানুষ ভিড় করেন।

রোববার রামপুরা বাজারের কাছে ওএমএসের চাল-আটার জন্য এসেছিলেন রেখা রাণীও।

পরে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর ৩টা পর্যন্ত সেখানে ট্রাক থেকে তেল, চিনি ও ডাল বিক্রি করা হয়। পণ্য শেষ হয়ে গেলে লাইনে থাকা কয়েকশ মানুষকে ফিরতে হয় খালি হাতে।

ফরিদার মত ব্র্যাক ব্যাংকের উল্টোপাশে ভোর থেকে অপেক্ষায় থাকা আব্দুল আলীম নামের একজন জানান, টিসিবির ট্রাক সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এই এলাকায় একবার এসেছিল, কিন্তু লাইনে শত শত মানুষের ভিড় দেখে ট্রাকটি ঘুরে চলে যায়।

একই সময়ে একই চিত্র দেখা গেল কয়েকশ গজ দূরে ওএমএসের চাল-আটার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকে। পরে সেখানেও ট্রাক না আসায় খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের।

ওয়াবদা রোডের বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন তেল-ডাল কেনার আশায় টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি বলেন, “করোনার মধ্যে আমরা সবগুলো একসাথে দাঁড়িয়ে থাকি, এতে তো আমাদের রোগ হওয়ারও সমস্যা হয়। বাজার দরটা একটু কমায়ে দিলে তো আমাদের মত মহিলাদের ঘর থেকে বের হওয়া লাগে না। এখন একজনে পায়, তিনজনে পায় না।”

সালমা সুলতানা নামে আরেক গৃহিণী বলেন, “এখানে যে এভাবে এসে দাঁড়াইয়ে থাকি আমাগো কী করোনা হবে না? তারা না আসলে না বলব যে, আমরা আজকে আসব না, ওমুক দিন আসবো। আইন্যা আমাগো কেন সাজা দিতেছে?”

একটি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দপ্তরি মো. সামছুল হক জানান করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর তার বেতন অর্ধেকে নেমেছে। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

রোববার রামপুরা বাজারের কাছে টিসিবির পণ্য না পেয়ে ফিরে গেছেন সালমা সুলতানা নামের এই গৃহিণী।

টিসিবির ট্রাক আসবে বলে ভোর সাড়ে ৫টায় থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত লাইনে অপেক্ষা শেষে ফিরে যান তিনিও।

সামছুল বলেন, “হিসেব করে সংসার চলাতে হচ্ছে। বাজারে জিনিসের দাম এত বেশি যে সব সময় প্রয়োজনের জিনিস কিনতে পারি না। এখানে এসেছিলাম দাম একটু কম পাওয়া যাবে বলে, কিন্তু আমাদেরকে জানিয়ে দিল ট্রাক আসবে না।”

মো. বশির নামে এক প্রাইভেট কার চালকও টিবিসির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসেছিলেন। লকডাউনের কারণে তার বেতনও এখন অর্ধেক।তিনি বলেন, “আমি এখানে সকাল ৬টা এসেছি, সাড়ে ১০টা বাজে এখনও লাইনে আছি।”

রোববার রামপুরা এলাকায় টিসিবির ট্রাকে পণ্য বিক্রির দায়িত্বে ছিল মেসার্স বাবু এন্টারপ্রাইজের।

রোববার রামপুরা বাজারের কাছে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন বেসরকারি একটি স্কুল ও কলেজের দপ্তরি সামছুল হক।

সচরাচর সকাল ৯টায় ট্রাক আসলেও রোববার ১১টার পরে ট্রাক আসার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোডাউন থেকে মালামাল ভর্তি করে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা বেজে যায়। এরপর গাড়ি আসতে হয়, যে কারণে সময় লাগে।”

অন্যত্র ট্রাক থামানোর বিষয়ে তার দাবি, “আমাদের নির্ধারিত স্থান হল একরামুন্নেছা স্কুল, অর্থাৎ টেলিভিশন স্টেশনের সামনে, সেখানেই ট্রাক থামানো হয়েছে, সেখান থেকেই বিক্রি হয়েছে।”

বহু মানুষের খালি হাতে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে এই ডিলার বলেন, “আমাদের যে বরাদ্দ তা সীমিত, যে কারণে চাহিদা থাকা সত্বেও দেওয়া সম্ভব হয় না। লকডাউনে সরকার বহু প্রণোদনা দিচ্ছে, আমরা মনে করি খোলা বাজারে যদি বিক্রি বৃদ্ধি করত, তাহলে বেশির ভাগ মানুষ উপকৃত হত, এর স্বচ্ছতাও আছে।”

এদিকে রামপুরার ওএমএস ট্রাক থেকে চাল-আটা কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ওয়াবদা রোডের আরেক বাসিন্দা রেখা রাণী। পাঁচ সদস্যের পরিবারে স্বামী সেলুনে কাজ করলেও এখন কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে আছেন তিনি।

রোববার রামপুরা বাজারের কাছে টিসিবির পণ্য কিনতে ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ছিল এমন দীর্ঘ লাইন। পরে সেখানে আর ট্রাক না আসলে পুলিশ সবাইকে চলে যেতে বলে।

রেখা বলেন, “এখানে মাঝে মাঝে চাল-আটা নিয়ে ট্রাক আসে, কিন্তু একবার পাইলে তিনবার ফিরে যায়। গত বৃহস্পতিবার এরা এসেছিল, সেদিন পাইনি। বলে গেছিল আজ আসবে (রোববার), কিন্তু কয় আসলো না তো।”

পরের বাড়িতে কাজ করে মা ও দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেন পূর্ব রামপুরার বাসিন্দা মনি বেগম। মাকে সঙ্গে নিয়ে চাল-আটার জন্য এসেছিলেন তিনিও।

মনি বলেন, “বৃহস্পতিবারেও তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু চাল পাইনি। আজকে রবিবারে আসলাম, আজকে তো গাড়িই আসে নাই।

“পেটে ভাত নাই। কয়েকটা টাকা ধার করে এনেছি চাল নেওয়ার জন্য। কোনোখানে কাজও নাই যে, কাজ করে ভাত খেতে পারব।”

আরও পড়ুন