অবৈধ সংযোগে দৈনিক চুরি হতো ২০ কোটি টাকার গ্যাস

মাত্র তিন দিনে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের কিছু এলাকায় তিতাস গ্যাস ৭০ হাজারের বেশি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকার গ্যাস চুরি হতো।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2021, 07:01 PM
Updated : 24 May 2021, 07:01 PM

এসব অবৈধ সংযোগের মধ্যে শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক লাইনও রয়েছে। গ্যাস পেতে সংযোগগুলোর বিপরীতে মাসে মাসে টাকাও দিচ্ছিলেন গ্রাহকরা।

তবে সেই টাকা সরকারি কোষাগারে না গিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা ও স্থানীয় কিছু ‘দালালদের’ পকেটে যেত।

তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি কেবল চারটা সাইটে অভিযান চালিয়েছি। এরকম আরও ১০/১২টা হাব রয়েছে অবৈধ গ্যাসের। পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকায়ও অভিযান চলবে।”

জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও তিতাসের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে আরও কিছু অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে, যা আগামী এক মাসের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে।

এরপর তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান, যিনি তিতাস গ্যাসেরও চেয়ারম্যান।

তিতাস ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজস ছাড়া বিশাল এই অবৈধ কারবার সম্ভব নয়; তাদের কেউ কেউ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিতাস ও জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সমর্থন ছাড়া বছরের পর বছর ধরে এতবড় চুরি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

“আরও ছয় বছর আগে তিতাসকে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিল বিইআরসি। এতদিনে কী কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো না সেটা নিয়েই বরং আলোচনা করা উচিত।“

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বলেন, “২০১১-১২ সালে এই অবৈধ সংযোগের সূত্রপাত। তারপর ধীরে ধীরে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। স্থানীয় কিছু অসাধু মানুষ এই অবৈধ সংযোগের জন্য জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছে। আমাদের কিছু লোকও এর ভাগ পেয়েছে। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত।”

জড়িতদের চিহ্নিত করে মামলা করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মামলা নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবছি না। দেশের সম্পদ আগে বাঁচাতে হবে। মামলার বিষয়টি পরে আসবে।“

এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘জনগণের’ অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকায় কতদিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে সেটাই আশঙ্কা তিতাস গ্যাসের এমডির। তিনি বলেন, “কীভাবে আমাদেরকে সরানো যায়, অভিযান বন্ধ করা যায় এসব নিয়ে তারা সংগঠিত হচ্ছে।”

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান বলেন, “এই অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের কাজটি গত এক বছর ধরেই করে যাচ্ছি। এখন কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ফাইল ছবি

“আগে কেবল অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হত। এখন একেবারে উৎসমুখ থেকে সংযোগ বন্ধ করে দিচ্ছি। ফলে কিছু বৈধ সংযোগধারীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।“

তিন দিনে ৭২ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে হয়তো কয়েকশ বৈধ গ্রাহক রয়েছে। তাদেরকে আমরা পরে সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”

অবৈধ সংযোগের সমস্যাটা নারায়ণগঞ্জে বেশি উল্লেখ করে তিতাসের চেয়ারম্যান বলেন, “বিচ্ছিন্ন করা সংযোগগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকার গ্যাস চুরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

এই অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছর ২০/২৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডিজিএম কিংবা এজিএম পর্যায়ের কর্মকর্তাও ছিলেন। অনেককে চিরস্থায়ীভাবে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি সচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ও চাকরিচ্যুতি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যারা খুব বেশি সম্পত্তির মালিক হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য দিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।

“এখন আমরা সিবিএ নেতাদেরকেও ছাড় দিচ্ছি না। কারণ তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।“

আগামী এক মাসের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।  

তিতাসের এমন পদক্ষেপের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে প্রশংসা করার পক্ষপাতি নন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এতদিন তারা অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেনি কেন। তাদের লোকজনই সংযোগ দিয়েছে, তারাই বিচ্ছিন্ন করেছে। বিচ্ছিন্ন করার জন্য তাদের প্রসংশা করছি না। এতদিন এই সংযোগ থাকল কী করে আমি সেই প্রশ্ন তুলছি।“

এর সঙ্গে তিতাসের লোকজন জড়িত অভিযোগ করে তিনি বলেন, “একারণেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এত সময় লেগেছে। এ কারণেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার হওয়া উচিত।

“তারা ঘুষ নিয়েছে, কেজির মাপে ওজন করে ঘুষ নিয়েছে। ধরা পড়ার পরও এগুলোর বিচার হয়নি। জ্বালানি সচিব তিতাসের বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পরও বিচার হয়নি। তাহলে কী করে এর প্রতিকার হবে।“

৭০ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন

রোজার ঈদের পরের দিন থেকে টানা সাতদিন ধরে চলে এই অভিযান। এর মধ্যে ৭০ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তিন দিন।

বাকি দিনগুলোতে সংযোগের ম্যাপ ও মাঠের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন তিতাসের কর্মকর্তারা।

এগুলোর বেশিরভাগ আবাসিক সংযোগ। এর মধ্যে শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যক লাইনও রয়েছে বলে তিতাসের কর্মকর্তারা জানান।

তিতাস গ্যাস জানায়, ১৫ থেকে ২২ মে পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, কাঞ্চন এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এই অভিযানকালে অবৈধ সংযোগের নেটওয়ার্ক দেখে মূল পয়েন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

গত ১৫ মে সোনারগাঁও উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের বিআর স্পিনিং মিলের পাশে থাকা ৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৪০ পিএসজিআই ভাল্ব আউটলেট থেকে অবৈধভাবে নেওয়া ১০ কিলোমিটার লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

এতে সামুরকান্দি, বোস্তল, তালতলা, মদনপুর, দড়িকান্দি, গাড়েরপাড় ও ফাউসা এলাকার সাত হাজার বাসাবাড়ি, ১০০টি ছোট শিল্প, পাঁচটি রেস্টুরেন্টের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা গেছে।

২২ মে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ায় চনপাড়া ব্রিজের পশ্চিম পাশে থাকা রিভার ক্রসিং ভাল্ব বন্ধের মাধ্যমে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের খামারপাড়া, তালাশকুর, নগর পাড়া গ্রামের প্রায় ৮ কিলোমিটার বিতরণ লাইনের দুই হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

২০ মে রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় ৫০ পিএসআইজি চাপের ৬ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন থেকে যাওয়া এক হাজার বৈধ ও ৪০ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ১৪০ পিএসআইজির ৮ ইঞ্চি ব্যাসের ৫ কিলোমিটার ডেডিকেটেড গ্যাস লাইন বসানো হয়েছিল টিকে গ্রুপের জন্য। এই বৈধ লাইন থেকে বৈদ্যেরগাঁও, মাথাভাঙা, রসুলপুর, ইমামপুর, বাঘাবন্দি, ষোলআনিসহ অন্যান্য এলাকায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাইপলাইন টেনে ১২ হাজার অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছিল।

গত ২২ মে তারিখের অভিযানে এসব সংযোগ গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।

অবৈধ সংযোগ ব্যবহারকারীদের একজন নারায়ণগঞ্জের মনির হোসেন। সরকার বৈধ সংযোগ বন্ধ রাখার কারণেই তিনি এমন সংযোগ নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেন।

তিনি নতুন গ্যাস সংযোগ চালুর মাধ্যমে এগুলোকে বৈধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আক্তার হোসেন নামে আরেকজন বলেন, কোনো নোটিস ছাড়া হঠাৎ করে কাঞ্চন পৌরসভায় গ্যাস বন্ধ করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

উত্তরা জুট মিল অ্যান্ড ফাইবার ইন্ডাসট্রিজের সিবিএর (শ্রমিক সংসদের সভাপতি) সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, নোটিস ছাড়া আবাসিক লাইনের পাশাপাশি শিল্প লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

বৈধ সংযোগ ব্যবহারকারী তারিকুল ইসলাম বিপুল বলেন, “অবৈধ গ্রাহকদের জন্য আমরা কেন ভোগান্তির শিকার হবো। তিনি পুনরায় তাদের সংযোগ দ্রুত চালুর অনুরোধ করেন।

বৈধ সংযোগ ব্যবহারকারী শাহিন মিয়া অবৈধ সংযোগগুলোও বৈধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি।