রয়টার্স বলছে, চলতি সপ্তাহে টেলিনর মিয়ানমারে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রাজস্ব হারিয়েছে। অথচ গত বছর কোম্পানির মোট আয়ের ৭ শতাংশ সে দেশ থেকে এসেছিল।
এক দশক আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি যখন সামরিক শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করল, তখন ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিমের হাতেগোনা যে কয়টি কোম্পানি মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছিল, সেগুলোর একটি টেলিনর।
নরওয়ের এ কোম্পানি মিয়ানমারে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী।
টেলিনরের প্রধান নির্বাহী সিগভে ব্রেককে বলেন, “আমরা অনেক ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে আছি।”
১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে শত শত মানুষের প্রাণহানির মধ্যে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে বাড়তি নজরদারির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে ব্রেককে বলেন, “টেলিনর আপাতত ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।”
সামরিক বাহিনী আবারও মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর সেই উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ক্রিস সিদোতি বলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীকে তহবিল যোগায় এমন কর বা নিবন্ধন ফি টেলিনরের পরিশোধ করা উচিত নয়।
“মিয়ানমারে ‘ভালোর চেয়ে খারাপ করছে’ কিনা সে বিষয়ে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না হলে টেলিনরের উচিত সেখান থেকে সরে আসা।”
অবশ্য এসপেন বার্থ ইডের মত ভিন্ন, যিনি ২০১৩ সালে মিয়ানমারে টেলিনরের নিবন্ধন পাওয়ার সময় নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, টেলিনরের উচিত মিয়ানমারে থাকা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বিদেশি কোম্পানি হিসেবে নিজেদের অবস্থান ব্যবহার করে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করা।
টেলিনরের মালিকানায় নরওয়ে সরকারের বাণিজ্য, শিল্প ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ও অংশীদার। ওই মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে টেলিনর মিয়ানমারে টানাপড়েনের মুখোমুখি।
তিনি বলেন, করপোরেট সুশাসন বিবেচনায় মিয়ানমারে টেলিনরের বিনিয়োগের বিষয়ে দায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপক দলের। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে নরেওয়ে সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় টেলিনরের সঙ্গে বড়জোর আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতা দখল করা সামরিক জান্তা চলমান সহিংসতার জন্য মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত দল ও আন্দোলনকারীদের দোষারোপ করছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, সামরিক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে তারা টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও সাড়া পায়নি।
নতুন বাজার
পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে সামরিক সরকারের অধীনে ব্যবসা করে আসা টেলিনরের কাছে মিয়ানমারের এই পরিস্থিতি খুব অচেনা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার একটি নির্দেশ নিয়ে থাইল্যান্ডের সেনা সরকারকে তারা চ্যালেঞ্জও করেছিল।
ঠিক ওই সময়েই তারা মিয়ানমারে নতুন গ্রাহক তৈরি শুরু করছিল।
টেলিনরের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী জন ফ্রেডরিক বাকসাস বলেন, গণতন্ত্র বেশি দিন নাও টিকতে পারে- এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে মিয়ানমারে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়ে তখন অনেক চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছিল।
“আমাদের যুক্তি ছিল, পশ্চিমা কোম্পানি হিসেবে কোনো দেশে টেলিযোগাযোগ সেবা দিতে গেলে আমাদের কিছু দায়িত্ব নিতে হবে; ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনার বিষয়েও খানিকটা নিশ্চয়তা থাকতে হবে।”
মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনর্বহালের প্রক্রিয়ায় বরাবর সমর্থন যোগানো নরওয়ে সেদেশে টেলিনরের বিনিয়োগকে সমর্থন দিলেও ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছিল বলে জানান তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্থ ইডে।
তিনি বলেন, “আমরা তাদের বলেছিলাম, দেশটা বড্ড জটিল, আর সেখানকার সামরিক শাসনও যথেষ্ট কঠোর। টেলিনর এ ব্যাপারে ভালোই জানত ... এমন নয় যে তারা নবিশের মত সেখানে গেছে।”
মিয়ানমারে টেলিযোগাযোগ ব্যবসা পরিচালনার জন্য ২০১৩ সালে দুটি বিদেশি কোম্পানি নিবন্ধন পায়, যার একটি টেলিনর, অন্যটি কাতারভিত্তিক উরেদু।
টেলিনরের ১৮ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহকের ৯৫ শতাংশই এশিয়ার। মিয়ানমারে এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন, যা সেদেশের পাঁচ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশ।
‘নেই সরাসরি কোনো যোগসূত্র’
মিয়ানমারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে টেলিনরের জন্য অন্যতম সঙ্কট হল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ‘বাণিজ্যিক যোগসূত্র’ এড়িয়ে চলা।
বাকসাস বলেন, মিয়ানমারে কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ কর্মীদের অফিসের মেঝেতে বসে কাজ করতে হয়েছে। কারণ আমদানি করা আসবাবপত্র ছাড়ের জন্য শুল্ক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে রাজি হয়নি টেলিনর।
মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে হয়েছে বলে তিনি জানান।
সর্বোপরি মিয়ানমারের জমি থেকে খামার, খনি থেকে ব্যাংকিং খাত- সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়তো ছিলই।
সে দেশের সামরিক বাহিনী বিরুদ্ধে দশকের পর দশক ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতন, সহিংস পন্থায় আন্দোলন দমনসহ মনবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে- যা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে তারা।
নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠী জাস্টিস ফর মিয়ানমার তাদের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৫ সালে একজন সামরিক ঠিকাদারের মাধ্যমে মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের চুক্তি করে টেলিনর, যার মাধ্যমে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার নীতি রক্ষায় ‘উদ্বেগজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে’ ওই কোম্পানি।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, টেলিনর যে ভবন ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যালয় স্থাপন করেছে, সেটা নির্মিত হয়েছে সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন জমিতে।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের সম্পর্ক ছিণ্ণ করার সুপারিশও ওই প্রতিবেদনে করা হয় ।
রয়টার্স জানিয়েছে, তাদের প্রশ্নের জবাবে টেলিনরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ২০১৫ সালের অভিযোগটি তারা আমলে নিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি তিনি।
ভাড়া ভবনে কার্যালয় স্থাপনের ব্যাখ্যায় ওই মুখপাত্র বলেন, নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিবেচনায় সেটাই তাদের জন্য ‘একমাত্র বিকল্প ছিল’।
মুখপাত্র আরও বলেন, “টেলিনর মিয়ানমার সব সময়ই চেষ্টা করে আসছে, যাতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যতটা সম্ভব কম সংশ্লিষ্ট থাকা যায় এবং সামরিক বাহিনী-নিয়ন্ত্রিত কোনো কিছুর সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগও নেই।”
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর টেলিনর তিন জন ঠিকাদারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, যাদের সঙ্গে সামরিক জান্তার যোগাযোগ ছিল বলে কোম্পানি জানতে পেরেছে।
তাল মিলিয়ে চলা
অভ্যুত্থানের দিনই সামরিক বাহিনী টেলিনর ও অন্যান্য অপারেটরদের নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করে। এই নির্দেশের সমালোচনা করলেও তা পালন করে টেলিনর। এরপর কিছু সময়ের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা চালুর অনুমতি মিললেও ১৫ মার্চ থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ আছে।
অন্যান্য অপারেটরদের মত টেলিনরও মার্চে দখলদার জান্তা সরকারের কাছে নিবন্ধন ফি পরিশোধ করেছে। সমালোচকরা বলছেন, এটা গণবিক্ষোভ দমনে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করতে পারে।
এ বিষয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে টেলনর ইমেইলে বলেছে, তারা অর্থ পরিশোধ করলেও ‘চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে’।
টেলিনরের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার নরওয়ের কেএলপি জানিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকির বিষয়গুলো যাতে চিহ্নিত করা যায়, সেজন্য অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা টেলিনরের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
টেলিনরের সিইও ব্রেককে বলেন, মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি কোম্পানির সামনে থাকা সঙ্কটগুলোর একটি। এর পাশপাশি রয়েছে নিরাপদে গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করা এবং নেটওয়ার্কে তাদের প্রবেশের সুযোগ বজায় রাখা।
“আমরা এই নিক্তির ওপরেই প্রতিটি দিন কাজ করে চলেছি।”
এখন পর্যন্ত এই ‘তাল মিলিয়ে চলার’ নীতিতে টেলিনর মিয়ানমারে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
“পরিস্থিতি এমন অনিশ্চিত অবস্থায় থাকলে, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের ধারণা করা অসম্ভব”, বলেন ব্রেককে।