গতবছরও পহেলা বৈশাখের বাজার যখন নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি, পাঞ্জাবী, থ্রি-পিস ও কুর্তা দিয়ে সাজানো হয়েছিল, তখনই আসে ‘লকডাউন’ ।সে সময় লোকসান ও ঋণের বোঝা হালকা করতে ফ্যাশন হাউজগুলোতে চলে কর্মী ছাঁটাই।
এ বছর রোজার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে হাউজগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিলেও মহামারীর আঘাত এসেছে আরও বেশি তীব্রতায়।
সম্প্রতি রাজধানীর নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কাঁটাবন, শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স ও মিরপুরের ফ্যাশন হাউজগুলো ঘুরে বৈশাখী পোশাকের সম্ভার দেখা যায়নি খুব একটা। দোকানগুলোতে ক্রেতাদের নেই কোনো ভিড়। তবে গত এক সপ্তাহের তুলনামূলক বেশি ক্রেতা দেখা গেছে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশার কথা শুনিয়েছেন অন্যতম ফ্যাশন হাউজ ‘রঙ বাংলাদেশের’ ব্যবস্থাপক সৌমিক দাস। ছোট উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বড় ফ্যাশন হাউজগুলোও বিক্রয়কেন্দ্র কমানোর চিন্তা করছে বলে জানান তিনি।
“আমরা তো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। মহামারীর কারণে ফ্যাশন শিল্পটাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন অফিস ছোট করে, বেশি লোকসানে থাকা আউটলেটগুলো বন্ধ করে দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টায় আছি।”
মহামারী শুরুর পর সরকার বিভিন্ন ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ব্যাংকের নানা শর্তের কারণে দেশীয় ফ্যাশন উদ্যোক্তারা সেই সুবিধা নিতে পারেননি বলেও জানান সৌমিক। আর বাজার ঘুরে না দাঁড়ানোর কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণের প্রয়োজনই হয়নি।
“গত বছর সেই বৈশাখ আর ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে দেশে লকডাউন এলো। সবকিছু থেমে গেল, কোটি কোটি টাকার পণ্য পড়ে থাকল বিক্রির আশায়। এবারও একই সময়ে গত বছরের পুনরাবৃত্তি হলো। ফ্যাশন শিল্পের কতজন উদ্যোক্তা সামনের দিকে টিকে থাকতে পারবে সেটা বলা মুশকিল। আমরা অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম এবার বৈশাখ ও ঈদকে সামনে রেখে। কিন্তু এই ধাপেও ঘুরে দাঁড়ান গেল না।
“২০১৯ সাল যে ভালো গিয়েছিল ব্যাপারটা ওরকমও না। ২০২০ সালে বেচাকেনা ৭০ শতাংশ ড্রপ করল। ২০২১ সালেও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে। এতোগুলো ধাক্কা সামলে একটা খাত কিভাবে টিকে থাকতে পারে?”
বড় ফ্যাশন হাউজগুলোর সঙ্গে অনেক ছোট কারিগরের ভাগ্য জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বড়রা ছোটদের দিয়ে কাজ করায়। ছোটরাও নিজেদের কাজের পাশাপাশি বড়দের দু’চারটা অর্ডার পেয়ে টিকে থাকে। কিন্তু দুই বছর ধরে সেটা তো আর হচ্ছে না। সামনে কী হবে, আমরাই কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবো, এনিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেনা।”
একক মালিকানার ১৬টাসহ যৌথ মালিকানা মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে মোট ২৫টি শো রূম রয়েছে ‘রঙ বাংলাদেশের’। ইতোমধ্যেই অফিস ছোট করে আনা হয়েছে তাদের। লোকসান কমাতে কিছু শো-রুম বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে জানান সৌমিক।
আজিজ সুপার মার্কেটে ফ্যাশন হাউজ ‘মেঘ’ এর ব্যবস্থাপক শামসুল ইসলাম বলেন, পহেলা বৈশাখ ও ঈদের ১০ দিন আগে সাধারণত বেচাকেনার ব্যস্ততা বাড়ে। গত বছর লকডাউনেই গেছে, এবার যে কয়দিন খোলা ছিল তাতেও কোনো বেচাকেনা হয়নি।
“বৈশাখী উৎসব উপলক্ষে প্রতিবছর শো-রুম ও পাইকারি মিলিয়ে ৪০/৪৫ লাখ টাকার সেল হয়। এবার সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকাও হয়নি। দোকানে দৈনিক বিক্রি ২/৪ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। যেখানে ৪০-৫০ হাজার টাকাও বিক্রি হয়েছিল দুই বছর আগে।”
ফ্যাশন ব্যবসায় কমবেশি সবাই এখন অনলাইন মার্কেটিংয়ে ঝুঁকে পড়ছেন বলে জানান শামসুল।
“এখন এই পরিস্থিতিতে আমরা অনেকটা অনলাইনের বিক্রির দিকে তাকিয়ে আছি। দিনে ৪/৫টা ড্রেস বিক্রি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সেটা অফলাইনের চেয়েও বেশি। দেশের সব প্রান্ত থেকেই অর্ডার আসছে।
টানা দুই বছরের ধাক্কায় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রি কমার পাশাপাশি কমেছে আউটলেটও। ফলে চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন অসংখ্য তরুণ-তরুণী।
‘মেঘ’ ফ্যাশন হাউজেরই ঢাকায় আরও পাঁচটি শো রুম ছিল। কিন্তু অব্যাহত লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে এখন একটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
গত রোববার আজিজ মার্কেটের ‘লাম্মি ক্রাফট’ নামের আরেকটি শো রুমে গিয়েও পাওয়া গেল একই ধরনের চিত্র। পুরো দোকানে কোনো ক্রেতা নেই; নেই বেচাকেনার ব্যস্ততা।
দোকানের ব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন জানান, ১০ বছর ধরে তিনি এই ব্যবসায় যুক্ত। ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণে গত বছরই তাদের মোট ১০ জন কর্মচারীর মধ্যে চারজনকে বাদ দিতে হয়েছে। এই বছর ক্ষতি পোষানোর আশা থাকলেও তা আর হয়ে উঠেনি।
“বৈশাখী পণ্যের ক্রেতা নেই। যেহেতু কোনো উদযাপন নেই, ক্রেতা না থাকারই কথা। দৈনিক ২০/২২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রির আশা থাকলেও সেখানে হচ্ছে মাত্র ৫/৭ হাজার টাকা। মাস শেষে লোকসানই গুণতে হচ্ছে।
“একটা দোকানের পেছনে মাসে ২০ হাজার টাকা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। সেখানে বৈশাখী মৌসুমেও মাস শেষে ১৫ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখা যায়না। এই পরিস্থিতিতে গুটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কী?”
সত্যিকারের গুটিয়ে যাওয়ার উদাহরণ পাওয়া গেলো পাশে ‘নীল ক্র্যাফট’ নামের আরেকটি শো রুমে গিয়ে। এই দোকানটিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে গত ছয় মাস ধরে আছেন রিপন আহমেদ। অথচ গত বছর তিনিই মালিবাগের সেন্টার পয়েন্ট মার্কেটে দুটি শো রুমের মালিক ছিলেন।
“প্রতি মাসে একটি দোকানে ২০/২৫ হাজার টাকা করে লোকসান দিয়ে আর পোষাতে পারি নাই। বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের বিদায় করেছি। আমিও চলে এসেছে আজিজ মার্কেটের এই দোকানে। এটি আমার ভাইয়ের দোকান। এখানেও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছোটখাটো মহাজন ছিলাম, এখন চাকরি করি। পকেট থেকে কত ভাঙা যায়।”
একই পরিস্থিতি মিরপুর-১০ নম্বর চত্বরে গড়ে ওঠা ফ্যাশন হাউজগুলোর।
ফ্যাশন হাউজ ‘ইজির’ ব্যবস্থাপক নূর আলম বলেন, “এবার ঈদ কিংবা বৈশাখে বেচাকেনা বলতে কিছু নেই। মানুষের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে পোশাক কিনে কী করবে।”
পাশের ‘গ্রামীণ সম্ভার’ নামের আরেকটি শো রুমে কথা হয় ব্যবস্থাপক হৃদয় শিকদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ১৬ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে তাদের।
“অথচ বৈশাখের দুদিন আগে এক লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হয়। দোকানে ১০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী। এই বিক্রিতে লাভ তো দূরের কথা ক্ষতিও পোষানো যাবেনা। মানুষ ফ্যাশনপণ্য কেনাকাটা করছেনা। চাল-ডাল, মাছ-মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বেশি নজর দিচ্ছে।”