প্রাচীন ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে মসলিনের মতো জড়িয়ে আছে এখানকার শঙ্খশিল্প। আধুনিকতার পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্য এখন নেই বললেই চলে। যন্ত্রে তৈরি ভারতীয় শঙ্খপণ্যের দাপটে ধুঁকছে ঢাকার এই শিল্প। জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা বদলে ফেলেছেন অনেক শঙ্খশিল্পী। কম দাম আর গুণে-মানে ভারতের শঙ্খপণ্য এগিয়ে থাকায় ঢাকায় এই শিল্পের প্রাণ আর ফেরানো সম্ভব নয় বলে শিল্পী-কারিগরদের শঙ্কা।
ঢাকার শঙ্খশিল্প মূলত পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার কেন্দ্রিক। বংশানুক্রমে এই শিল্পে জড়িয়ে আছে এখানকার অসংখ্য পরিবার। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন শিল্পের বর্তমান দুর্দশার কথা।
তারা বলছেন, বাঁক বদলের শুরু নব্বইয়ের দশক থেকে। পেশা টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে যন্ত্রের দিকে ঝুঁকলেও ভাগ্য বদলাতে পারেননি। ফলে পেশা বদলের যে হিড়িক শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতায় একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এই শঙ্খশিল্প। ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস মহামারী।
স্বপন নন্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একসময় দিনে সাত-আটশ টাকা রোজগার ছিল তার, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ৩০০ টাকাও ঘরে নিতে পারেননি।
“মহামারীতে তো ইনকাম একেবারে বন্ধ ছিল। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম কিছু একটা করি, কিন্তু পেশার মায়ায় হয় নাই, এইবার বাধ্য হইছি। যে মজুরি পাই, তাতে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাব কী? কাজ নাই দেখেই এইসব জিনিস বিক্রি করতেছি। এখন শাখা বানানোর ফাঁকে টুকটাক বিক্রি করেও দিনে ২০০ টাকা লাভ করতে পারি।”
উপার্জন কমে যাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন বলে জানান স্বপন।
“স্বাধীনতার পরে শাঁখারীবাজারে ৪০০ থেকে ৫০০ জন শঙ্খশিল্পী ছিল। এইটা কমতে কমতে নব্বইয়ের দশকে ৮০-৯০ জনে ঠেকে। এখন ১২ জন আছে। অনেকে মারা গেছে, অন্য পেশায় গেছে, ভারতে চলে গেছে।”
স্বপনের জবাব, “কাজটা না থাকলে মানুষ কী করবে? এই কাজ কইরা যদি খাওয়া না পায়, তাইলে কী করবে? আরেকটা কাজে যাইতে হবে। অনেকদিন কাজ করছি। কিন্তু এই শিল্পে কোনো উন্নতি নাই। আমাদের অনেকে চা বেচছে, রিকশা চালাচ্ছে। আমাদের চেয়ে তাদের বেশি ইনকাম। কিন্তু আমরা তো সেসব কাজে যেতে পারছি না।”
কাঁচামাল হিসেবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে যে সামুদ্রিক শঙ্খ আসত, তা পণ্যে রূপ দিতে ছয় ধরনের কারিগরের প্রয়োজন হত বলে জানান কারিগর শম্ভুনাথ সুর। এখন কারিগর কমে যাওয়ায় এর পাঁচ ধরনের কাজই ঢাকায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
“এখন আমরা এক ধরনের কারিগর আছি। আমরা শুধু শেষ ধাপের কাজটা করি। কিছু মেশিন পড়ে আছে, সেসবের কারিগর এখানে আর নেই। ফলে শাঁখা প্রস্তুতের আরও পাঁচ ধাপের যে কাজ, সেটা এখন ভারত থেকেই হয়ে আসে।”
শম্ভুনাথ জানান, শাঁখারীবাজারে হাতের অলঙ্কার ছাড়া অন্য শঙ্খপণ্যের কারিগররা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
“আগে শঙ্খ দিয়ে শাঁখা ছাড়াও গলার-কানের সেট, আংটি, লকেট, মাথার ক্লিপ তৈরি করা হত। এখন এগুলো বানানোর লোক নাই। বাদ্যশঙ্খ ও জলশঙ্খের দুইজন কারিগর ছিলেন সর্বশেষ। তারা মোটা অংকের মজুরি পেতেন। কাজ না পেয়ে এখন একজন শঙ্খের দোকানে তিনশ টাকার মজুরিতে কাজ করছেন।”
শাঁখারীবাজারের শঙ্খশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মতে, ভারতীয় পণ্যের বিস্তৃতিই এদেশে শাঁখা উৎপাদনকে সঙ্কুচিত করে ফেলেছে।
কীভাবে এই পরিবর্তন ঘটল, তা উঠে এসেছে নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী সুদীপ্ত সুরের কথায়। বাবার ব্যবসা চালিয়ে আসা এই ব্যবসায়ী জানান, তাদের সব শাঁখাই এখন ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
“এখন কারিগর কম, উৎপাদনও কম। ভারত থেকে শঙ্খ এনে দেশে (পণ্য) তৈরি করতে খরচটা বেড়ে যায়। তাই আমরা রেডিমেইড শাঁখা, বাদ্যশঙ্খ এগুলো ভারত থেকে কিনে আনি। এতে আমাদের লাভ হয় বেশি।”
বিধান শঙ্খ ভাণ্ডারের মালিক ভবতোষ নন্দী জানান, দেশে তৈরি শঙ্খ মজবুত হলেও ডিজাইনে ভারতীয় শঙ্খ এগিয়ে রয়েছে।
“ভারতে শঙ্খের চাহিদা অনেক বেশি। শঙ্খটা পাওয়া যায় ভারতেই। তাই ওখানে উৎপাদন বেশি হয়, দামটাও কিছুটা কম হয়। আমাদের দেশে তো শঙ্খ পাওয়া যায় না, ভারত থেকেই আনতে হয়।”
তার মতে, দেশের শঙ্খ উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ এটাই।
বংশগতভাবে এ ব্যবসায় জড়িত ভবতোষ বলেন, “৩০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় শাঁখা পাওয়া যায়। আমাদের এখানে কারিগররা যেটা বানায়, সেটা মজবুতও হয়। তবে দামটা ভারতেরটার তুলনায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি পড়ে। একটু কম দাম আর ভালো ফিনিশিং পাওয়ায় কাস্টমাররা ভারতের শাঁখাটাই নেয়।
“আমাদের কারিগররা ২০ টাকা মজুরিতে সাধারণ একটা শাঁখা তৈরি করে দেবে না। কিন্তু এই মজুরিতে ইন্ডিয়া থেকে ওরা ঠিকই করে দিতে পারবে। ওদের প্রযুক্তিও অনেক উন্নত, সেজন্য ডিজাইনও আকর্ষণীয় হয়। কাস্টমার অনেক বেশি। কাজও অনেক বেশি। আমাদের বিক্রি কিন্তু কমে নাই। উৎপাদন কমে গেছে।”
কারিগর সঙ্কটের কারণে ভারতের পণ্য আনতে হচ্ছে বলে জানান নিউ অঞ্জলী শঙ্খ ভাণ্ডারের কর্ণধার সন্তোষ নন্দী।
“আমরা আগে তো দেশেই বানাতাম। এখনও আমার কয়েকজন কারিগর আছেন। কিন্তু তারা তো চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। অনেক কারিগর ভারতে চলে গেছেন। অনেকে কম মজুরির কারণে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কিন্তু ভালো কারিগর না হলে তো বেশি টাকা দিতে পারব না। সবাই তো লাভ করতে চায়।”
শাঁখারীবাজারে সবচেয়ে বেশি কারিগর কাজ করেন মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়ে। এই দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী অমোঘ নাগ মনে করেন, পরিস্থিতি যেখানে ঠেকেছে, সেখান থেকে ঢাকার শঙ্খশিল্পকে বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই।
“আমাদের ৫-৬ জন নিজস্ব কারিগর আছে। আমরা নিজেরা তৈরি করি। আমাদের ভারত থেকে আনার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কাস্টমাররা যেমন সস্তা দামে জিনিস চায়, সেটা আসলে এখানে তৈরি করে দেওয়া সম্ভব না।
“ভারতের অনেক বড় বাজার। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এসেছে। নিত্যনতুন ডিজাইন। সেটা কম দামে দেশের বাজারে আসছে। দেশে উৎপাদন করতে খরচ পড়ে এর চেয়ে বেশি। যে পরিমাণ চাহিদা আছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কারিগরও এখানে নেই। ফলে বাজার চলে গেছে ভারতের দিকে।”
ভারতীয় পণ্যের রমরমা বাজারের কারণে ব্যবসায়ীরাও কারিগরদের মজুরি কমিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান স্বপন নন্দী।
“আগের চেয়ে কাজ কমে গেছে। আবার মালিকরা রেটও কমিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলেন- ‘কাজ করলে করো, না করলে নাই’। এ কারণে আরও বেশি চাপে পড়ে গেছি আমরা। ১০ ঘণ্টা কাজ করে ৩০০ টাকা পাই, এতে তো সংসার চলে না।”
এসব কারণে ঢাকায় শঙ্খশিল্প আর টিকিয়ে রাখা যাবে বলেই মনে করছেন কারিগর শম্ভুনাথ সুর।
“আমাদের পূর্বপুরুষ বাপ-দাদারা এ পেশায় ছিল। তাদের কাছ থেকে শিখছি। মায়া থেকে এইটা ছাড়তে পারি না। ঐতিহ্যটা ধরে রাখতে চাই, আমরা চলে গেলে এটা আর এখানে বাঁচবে না।”