পিপলস লিজিং: ‘দায় এড়াতে পারে না’ বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার ‘যোগসাজশেই’ পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করছেন আমানতকারীরা।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2021, 12:50 PM
Updated : 20 Jan 2021, 12:55 PM

তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডিজিএমসহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ২০১৫ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার পরও সেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পথে নিয়ে গিয়ে আমানতকারীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) আমানতারীরা সোমবার ঢাকার মতিঝিলে সিটি সেন্টারের সামনে মানববন্ধন করেন। পরে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি স্মারকলিপি দেন, সেখানেও অভিযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিতে ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র আমানতকারীগণদের কাউন্সিলের আহ্বায়ক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, সেক্রেটারি জেনারেল রানা ঘোষ, যুগ্ম আহবায়ক ও সমন্বয়কারী সামিয়া বিনতে মাহবুব মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন।

সামিয়া বিনতে মাহবুব বুধবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। স্মারকলিপিতে আমরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম আমজাদ হোসেনসহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ২০১৫ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার পরও সেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ওই কর্মকর্তাও টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত আছে।

“নির্বাহী পরিচালক আমাদের বলেছেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন আছে। আদালত যে আদেশ দেন, সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”

১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে আবেদন অনুমোদন করলে ১০ জুলাই পিপলসের অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

একই বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা তোলার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। এর একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। আর এর পেছনে ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার।

পিকে হালদার নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর একটি হল পিপলস লিজিং।

প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। তার মা লীলাবতী হালদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাই কোর্ট।

পিপলস লিজিংয়ের ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের মধ্যে সামিয়া বিনতে মাহবুব, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শওকতুর রহমান এবং খালেদ মনসুর ট্রাস্ট্রের হিসাব শাখার কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম সম্প্রতি তাদের আমানত ফিরে পেতে হাই কোর্টের কাছে আকুতি জানান।

এ বিষয়ে শুনানিতে গত ৫ জানুয়ারি ওই বেঞ্চের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “আমানতকারীদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই কোম্পানি (পিপলস লিজিং) বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত। তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) কীভাবে চুপ থাকে! এত কিছু হচ্ছে, বিভিন্ন ব্যাংকে কত টাকা বিভিন্নভাবে ধ্বংস হচ্ছে, ক্রাইম হচ্ছে!

“বললেই হবে না আমরা কিছু জানি না! তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) জবাব দিতে দায়বদ্ধ। এ বিষয়ে পরে ধরব আমরা। ‘আমরা পারি না, পারব না, জানি না’- এ ধরনের কথা বলে তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) পার হতে পারবে না। এদেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে।”

সামিয়া বিনতে মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কিছুদিন দেখব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় কিনা। তারপর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে।”

আমানতকারীদের সোমবারের মানবন্ধনে অংশ নেওয়া ইউল্যাবের ট্রাস্টি বোর্ডের বিশেষ উপদেষ্টা অধ্যাপক ইমরান রহমান পিপলস লিজিংয়ের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংয়ের অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা না করে ‘অস্বাভাবিক দ্রুততায়’ অবসায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সাবেক ও বর্তমান গভর্নররা বরাবরই এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন।

তবে পিপলস লিজিং কেলেঙ্কারি নিয়ে আমানতকারীদের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কোনো কথা বলতে চাননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া আমানতকারীদের কাউন্সিলের স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, পিপলস লিজিং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি। ১৯৯৩ সালের বাংলাদেশ সরকারের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ডিন্যান্স ও নীতিমালা অনুযায়ী পিপলস লিজিংয়ের সঠিক তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।

“কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার সঠিক দায়িত্ব পালনে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে রাখা আমানতকারীদের অর্থ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা যেন লুটপাট করতে পারেন, সে সুযোগ করে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডিজিএম আমজাদ হোসেনসহ কিছু কর্মকর্তা।

“কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক তদারকি না থাকায় এবং তাদের ব্যর্থতার কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়ন করা হয়েছে। এতে ৬ হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারীর হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে। তারা আমানতের টাকা তুলতে না পেরে অনাহারে-অর্ধহারে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছেন।

“অনেকের ছেলেমেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে আমানতের টাকা ফেরত না পাওয়ার শোকে ছয়-সাত জন আমানতকারী মৃত্যুও বরণ করেছেন।”

স্মারকলিপিতে বলা হয়, আমনতকারীদের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পি কে হালদার একাই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডা পালিয়ে গেছেন।

“তিনি কীভাবে পালিয়ে গেলেন? শুধু তাই নয়, পিপলস লিজিংয়ের টাকা আত্মসাৎ করে অনেকে এখনও দেশে ঘুরে বেড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।”

কাউন্সিলের আহবায়ক আতিকুর রহমান আতিক বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রবাসীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় এখানে আমানত রেখেছেন।

“কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির কারণে পিপলস লিজিং অবসায়ন করতে হয়েছে। বর্তমানে আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে আমানতকারীরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।”