বাংলাদেশে খুচরা বাজারে সারা বছরই হিমায়িত আলুর দাম প্রতি কেজি ২২ টাকা থেকে ২৬ টাকার মধ্যে থাকে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন আলু ঘরে তোলার সময় দাম থাকে ২০ টাকার নিচে।
চলতি অক্টোবরের শুরু থেকে আলুর দাম প্রতি কেজি ২৫ টাকা থেকে বাড়তে শুরু করে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরায় এই দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপরই সরকার খুচরায় আলুর সর্বোচ্চ দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে না পেরে ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজি আলুর দাম সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
এই সিদ্ধান্তে অসন্তোষ জানিয়ে রাজশাহীর রহমান কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধিক ফলনের কারণে গত ১০ বছর ধরেই কোনো না কোনো মহাজন আলুতে লোকসান দিয়ে আসছেন। আমি নিজেও গত বছর লোকসান দিয়েছি।
“এবার বাজার ভালো থাকায় সবাই একটু মুনাফা করতে চেয়েছে। সরকার লোকসানে হস্তক্ষেপ না করলেও এখন মুনাফায় ঠিকই হাত দিয়েছে।”
সরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ৮ টাকা ৩২ পয়সা আর আলু যখন হিমাগারে সংরক্ষণ করা শুরু হয় তখন প্রতি কেজি আলুর দাম থাকে ১৪ টাকা।
সরকারি ব্যয় বিশ্লেষণে দেখানো হয়, এবার মওসুমে হিমাগারে সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। প্রতি কেজিতে হিমাগার ভাড়া বাবদ তিন টাকা ৬৬ পয়সা, বাছাইতে ৪৬ পয়সা, ওয়েট লস ৮৮ পয়সা, মূলধনের সুদ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২ টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ এক কেজি আলুর সংরক্ষণে সর্বোচ্চ ২১ টাকা খরচ পড়ে।
গেল মাসেও ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। সেই আলুর দাম হঠাৎ করে ৫০ টাকায় উঠে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, হিমাগার থেকে বের করার সময় বাড়ানো হচ্ছে আলুর দাম।
দেশের মোট আলুর সিংহভাগই আসে ঢাকার পাশের জেলা মুন্সিগঞ্জ থেকে। এছাড়া বগুড়া, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোও আলুর বড় যোগান আসে। মুন্সিগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলের চাষী ও মহাজনরা বলছেন, মৌসুমের শেষ দিকে এসে প্রতিবছরই আলুর দাম এভাবে বাড়তে থাকে। তবে সেটা সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ বা এর চেয়ে একটু বেশি স্থায়ী হয়ে থাকে।
এবার প্রায় দুই মাস আগে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আলুর মজুদ কমে আসার ভূমিকা রয়েছে বলে ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলামের ভাষ্য।
“প্রতিটি কোল্ড স্টোরেজের ৭০ শতাংশ আলু শেষ হয়ে গেছে। তখনই আলুর দাম বেড়ে গেছে। আমার যেমন ৫০০ বস্তা আলু ছিল। ৩০০ বস্তা বিক্রি হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে পাঁচটি হিমাগারের মালিক ফজলুর রহমানের কথায়ও তার বক্তব্যের সমর্থন মেলে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার আলুর আবাদ ‘কম হওয়ায়’ তার সংরক্ষণাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতার ৭৫ শতাংশ পূর্ণ হয়েছিল। ইতোমধ্যেই প্রায় ৮০ শতাংশ আলু ভোক্তা পর্যায়ে চলে গেছে। এখন প্রায় দুই লাখ বস্তা আলু রয়েছে যার মধ্যে ৪০ শতাংশ আলু ব্যবহার হবে নতুন বীজতলায়।”
মুন্সিগঞ্জের অন্যতম বৃহৎ হিমাগার মুক্তারপুরের দেওয়ান কোল্ড স্টোরেজের পরিচালক আরস দেওয়ান বলেন, তাদের হিমাগারে এখন প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বস্তা খাবার আলু রয়েছে। আর বিজ হিসেবে ব্যবহারের আরও এক লাখ বস্তা আলু রয়েছে।
“সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে দাম বেঁধে দেওয়ার পর অভিযান পরিচালনা করতে শুরু করে। এর ফলে আলুর বিক্রি একেবারেই কমে যায়। দেখা গেছে দৈনিক ৫০০ বস্তা আলুও বের করছিলেন না মহাজনরা। এখন প্রশাসন থেকে আমাদেরকে অলিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন দৈনিক তিন হাজার বস্তা আলু খালাস করি। এই কাজ করতে আমাদের লাভ কিংবা ক্ষতি কোনোটাই নেই। আমরা মহাজনদের মজুদের বিষয়টি হিসাব করে তিন হাজার বস্তা করে আলু বের করে দেব।”
দিনে তিন হাজার বস্তা আলু বের করলে তার হিমাগার থেকে দেড় মাসের মতো আলুর সরবরাহ পাওয়া যাবে। অপরদিকে দেশে নতুন আলু আসতে সময় লাগবে আরও মাস দুয়েক। বন্যার কারণে এবার আগাম আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন আলু আরও বিলম্বে আসতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
“দেশে যে আলু রয়েছে তা দিয়ে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত চলে যাবে বলে হিসাব করা হচ্ছে। তবে বন্যার কারণে নতুন আলু আসতে দেরি হলে সেক্ষেত্রে একটা সমস্যা হতে পারে,” বলেন রাজশাহীর হিমাগার মালিক ফজলুর।
তবে সরকারি হিসাবে দেশে আলুর মজুদ আরও অনেক বেশি থাকার কথা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত মওসুমে এক কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যেখানে বছরে আলুর চাহিদা ৭৭ লাখ টন। সেই হিসাবে ৩১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা।
তবে এরপরেও হিমাগারে সংরক্ষণকারীরা সরকারি নির্ধারিত দামে আলু ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন আফজাল হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী।
রাজশাহী অঞ্চল থেকে ঢাকায় আলু সরবরাহকারী আফজাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পর আমরা ৩২ টাকা থেকে ৩৪ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছি, কিন্তু তারা আলু বিক্রি করতে চাচ্ছে না। আলু পাওয়া যাচ্ছে না।
“গত দুই সপ্তাহে খুলনা ও ঢাকায় ট্রাক পাঠিয়ে আমার প্রায় ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। খুলনায় একটি ট্রাক পাঠিয়েছিলাম যার কেনা মূল্য ছিল ৪২ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হয়েছে ৩০ টাকায়। সেখানে প্রায় আড়াই লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সরকারের চাপে আড়ৎদার বিক্রি করে দিয়েছে। ঢাকায় যে ৪২ টাকা করে আলু পাঠিয়েছি সেটা ৩৪ টাকা থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে আড়ৎদাররা।“
আফজাল হোসেনের মতোই সম্প্রতি পাইকারি আলুতে টাকা লগ্নি করে লোকসানের মুখে পড়ার দাবি করেছেন আব্দুল গাফফার নামের আরেকজন ব্যবসায়ী। রাজশাহী থেকে ঢাকা, খুলনা, যশোর, সিলেট, কুমিল্লা অঞ্চলে আলু সরবরাহ করে থাকেন তারা।
এই দুই ব্যবসায়ী জানান, প্রতিবছর মৌসুম শুরুর পর ১৭ টাকা থেকে ১৮ টাকায় আলুর কেনাবেচা শুরু হয়। মৌসুমের শেষ দিকে এসে কয়েক দিনের জন্য আলুর দাম হয়ে যায় ৪০ টাকা। কিন্তু গত বছর মজুদ বেশি থাকায় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই নতুন আলু চলে আসায় কোল্ড স্টোরেজের আলুর দাম কমে ১২ টাকায় নেমে এসেছিল।
ব্যবসায়ীদের দিকেও নজর দেওয়ার দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ী ফজলুর বলেন, “অধিক ফলনের কারণে প্রতিবছরই শেষ সময়ে আলুর দাম একেবারে ২০ টাকার নিচে নেমে আসে। তখন অনেকেই লোকসান দিয়ে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করেন।
“এতে করে বিগত ১০ বছরে বহু কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, কেউ আবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে। সরকার তখন কৃষকের খবর নেয়নি। এখন সাময়িকভাবে দাম বাড়ার পর এই ধরনের হস্তক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত?”
এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে যাতে ভোক্তারা আলু পান, তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ চেয়েছেন ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় নাগারিক সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার সব কিছু বিবেচনা করে এই পরিস্থিতিতে আলুর দাম নির্ধারণ করেছে। আমরা সরকারের এমন পদক্ষেপে আস্থা রাখতে চাই। তবে মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে খুচরা বাজারের চেয়ে হিমাগার পর্যায়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকার বাজার পরিস্থিতি
চলতি মাসের শুরুতেই আলুর দাম বাড়তে শুরু করায় পণ্যটির উৎপাদন খরচ ও বাজার বিশ্লেষণ করে গত ৭ অক্টোবর সব পর্যায়ে পণ্যটির দাম নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
খুচরায় সর্বোচ্চ মূল্য প্রতিকেজি ৩০ টাকা ঠিক করে ধাপে ধাপে পাইকারি আড়তে ২৫ টাকা এবং হিমাগার পর্যায় থেকে ২৩ টাকা নির্ধারণ করা হয় আলুর দাম। কিন্তু বাজারে এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
পরে গত ২০ অক্টোবর ফের ৫ টাকা দাম বাড়িয়ে খুচরায় প্রতিকেজি আলু ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা দাম বেঁধে দেওয়া হয়।
মিরপুরের শাহআলী বোগদাদিয়া আড়তের পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, সর্বশেষ প্রতি কেজি ৩৭ টাকা করে আলু বিক্রি করেছিলেন তিনি। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে কোনো ব্যাপারী নতুন করে আলু নিয়ে আসছেন না । বেচাবিক্রি থেমে গেছে।
বুধবার মিরপুর-১ নম্বর এলাকার আরেক আড়ৎদার মোহাম্মদ সেলিম বলেন, “সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পর গত দুই দিন ধরে কোনো বেচাকেনা নেই। কারণ সরকার যে দামে বিক্রি করতে বলেছে ব্যাপারীদের কেনা দাম তার চেয়ে অনেক বেশি। আমরা ব্যাপারীদের বলে দিয়েছে বিক্রি না করলে আলু ফেরত নিয়ে যেতে।”
বৃহস্পতিবার কারওয়ানবাজারের বেশি কয়েকটি দোকানে ৩৬ টাকায় আলু বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে এই বাজারের অনেক আড়তেই এদিন বেচাকেনার ব্যস্ততা ছিল না।