চিনি কলে চিনি জমা; বাড়ছে দায়-দেনাও

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে এক দিকে চিনি জমে আছে, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন হচ্ছে না, দেনা মেটানো যাচ্ছে না আখচাষিদের।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2020, 04:43 PM
Updated : 30 Sept 2020, 04:43 PM

জমে থাকা চিনি বিক্রি করতে পারলে দায়-দেনার অনেকটা মেটানো যেত বলে চিনিকলগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তবে কলগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ভারসাম্য রাখতে সরকারের কিছু চিনি মজুদ রাখতেই হয়।

এই পরিস্থিতিতে দায়-দেনা মেটাতে সরকারের কাছে ৮৫০ কোটি টাকার অনুদান চেয়েছে করপোরেশন।

এদিকে পাওনার জন্য হা-পিত্যেস করা আখচাষিরা বলছেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে পাটের মতোই রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প ধুঁকছে।

এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের পরিচালনগত সমস্যাগুলো নিরূপণে একটি কমিটি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উদ্যোগে।

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে সারাদেশে ১৫টি চিনি কল রয়েছে।

দেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো। তার মধ্যে এক লাখ টনও চিনি কলগুলো থেকে আসে না; ফলে বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি করতে হয়।

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাদশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিনিকলগুলো থেকে আখচাষিদের ৩০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে।

“এক মওসুম শেষ হয়ে আরেক মওসুম শুরু হলেও এখনও কৃষকদের অন্তত ৩০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে চিনিকলগুলোর কাছে। অথচ এবছর সার ওষুধের অভাবে সঠিক পরিচর্যা করে আখ চাষ করা যায়নি।”

তিনি বলেন, দশকের পর দশক ধরে চলে আসা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চিনিকলগুলো এখন হাজার কোটি টাকার দেনার মধ্যে পড়েছে। তাদের অদক্ষতার দায়ভার এসে পড়েছে কৃষকের উপর।

গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে রংপুর চিনিকল।(ফাইল ছবি)

পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত জুলাই মাসের পর থেকে তাদের বেতন-ভাতা, ওভার টাইমসহ সব ধরনের মজুরি বকেয়া পড়ে রয়েছে।

প্রতি মাসে ৮০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বেতন বাবদ খরচ হয় এই চিনি কলে। পঞ্চগড় চিনি কলের গুদামে এখন ৩ হাজার ২০০ টন চিনি মজুদ রয়েছে।

রুহুল আমিন বলেন, “এবছর ২৪শ টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। পুরোনো চিনিসহ মোট মজুদ রয়েছে ৩২শ টন। এগুলো বিক্রি করা গেলে বেতন-ভাতা পরিশোধ সম্ভব হবে।”

মজুদ থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনুমোদিত ডিলাররা দীর্ঘদিন ধরে চিনি উত্তোলন করছেন না বলে মজুদ থেকে গেছে।”

এই চিনিকলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়েছে প্রায় দেড়শ টাকা। অথচ বাজারে তার দাম ৭০ টাকার বেশি নয়।

বেতনের দাবিতে বিক্ষোভে ফরিদপুর সুগার মিলের শ্রমিকরা। (ফাইল ছবি)

শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার সরকার বলেন, চলতি বছরে মে মাস থেকে (৫ মাস) চিনিকলের বেতন-ভাতা বাকি পড়ে আছে।

প্রতি মাসে এক কোটি টাকা হিসাবে এই কলে বেতন-ভাতা পরিশোধে খরচ হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। চিনি বিক্রি করে এসব টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও বিক্রি পর্যাপ্ত হয়নি।

শ্যামপুরে এই মুহূর্তে ১ হাজার ৭০০ টন চিনির মজুদ রয়েছে। প্রতি কেজি ৬০ টাকা হিসাবে এই চিনির বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।

শ্যামপুরে এবছর প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৭৪ টাকা। এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ খরচ হচ্ছে বছরে ২৬ কোটি টাকা। সেই টাকা উৎপাদনের সঙ্গে যোগ করলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ দাঁড়াচ্ছে ২৪৫ টাকা।

শ্যামপুর চিনি কলের এমডি বলেন, “সম্প্রতি ডিলাররা চিনি নেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। কিছুদিন আগে আমরা খোলা বাজারে ৫০০ টন চিনি বিক্রির অনুমোদন পেয়েছি। এই বিক্রি শেষ করতে পারলে একসঙ্গে কয়েক মাসের বেতন পরিশোধ করা যাবে।”

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বাণিজ্যিক শাখার পরিচালক আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিনি বিক্রি হচ্ছে না বলে যে প্রচার রয়েছে তা ঠিক নয়।

“বাজারে ভারসাম্য রাখার জন্য সরকারি গুদামে কিছু চিনি মজুদ রাখতে হয়। তাছাড়া আমাদের কাছে যে চিনি রয়েছে, তা আগামী মাড়াই মওসুম বা রোজা আসার আগেই শেষ হয়ে যাবে।”

চিনি কলে আখ মাড়াই। (ফাইল ছবি)

এ বছর ৭৯ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “বেচা-বিক্রি হয়ে এখন ৪০ হাজার টন চিনি রয়েছে। এগুলোও নতুন চিনি আসার আগেই শেষ হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন সব সেল দিলে পেঁয়াজের মতো বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যাবে।”

বিক্রির বিষয় আনোয়ার আরও বলেন, “আগোরাসহ অন্যান্য সুপারশপগুলো প্রতি কেজি ৬৫ টাকা করে আমাদের কাছ থেকে চিনি কেনে। দেশে ন্যাচারাল চিনির চাহিদা রয়েছে। সুতরাং এই মুহূর্তে সাদা চিনির মতো দাম কমিয়ে বিক্রি করা ঠিক হবে না বলেই আমরা মনে করি।”

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঠিকাদারদের বকেয়া, কৃষকের বকেয়া, জনশক্তির বেতন, গ্রাচুয়িটি, পেনশন ভাতাসহ বিভিন্ন খাতের খরচ বাবদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুদান হিসাবে ৮৫০ কোটি টাকা চেয়েছে করপোরেশন।

“শিল্প মন্ত্রণালয় সেটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠিয়েছে আজ থেকে দুই মাস আগে। এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সরকার থেকে টাকা পেলে আমরা বিভিন্ন খাতের বকেয়া পরিশোধ করতে পারব।”

এপ্রসঙ্গে আনোয়ার বলেন, “সরকার গত দুই বছরে আমাদেরকে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছে। সরকার বলছে নিজেরা নিজেদের টাকায় চলতে। সরকার আর কত দেবে?”

চিনি কলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আখ। (ফাইল ছবি)

দুর্নীতি অনিয়মের কারণে চিনি শিল্প দিন দিন পতনের দিকে যাচ্ছে দাবি করে আখচাষি দের  নেতা শাহজাহান বলেন, “এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলতে দিলে এই শিল্প অচল হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যেই বিষয়টি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি তদন্ত শুরু করেছে বলে জানতে পেরেছি।”

করপোরেশনের পরিচালক আনোয়ার বলেন, “কারখানা যা আছে এগুলো বছরে ৪০/৪৫ দিন চলে। বাকি ১০/১১ মাস তারা বসে বসে বেতন খায়। আমরা এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করব।

“প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে একটি পর্যালোচনা কমিটি করা হয়েছে। মিলগুলো কিভাবে সঠিক পথে আনা যায়। এগুলো ঠিক করতে দুই-তিন বছর সময় লাগবে।”

করপোরেশনের চেয়ারম্যান সনৎ কুমারও বলেন, চিনি শিল্পের সমস্যাগুলো চিহ্নিত এবং করণীয় ঠিক করতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি করা হয়েছে।

কমিটির কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে শিল্প সচিব কে এম আলী আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিষয়ে এখনও তার কাছে কোনো তথ্য নেই।