৬০ টাকার পেঁয়াজ একলাফে ১০০ টাকা

ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় গতবছরের মতো লাগামহীন হয়ে উঠতে শুরু করেছে পেঁয়াজের বাজার। রাতারাতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় মানুষও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনতে শুরু করেছেন।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2020, 11:51 AM
Updated : 15 Sept 2020, 11:51 AM

সোমবার প্রতিবেশি দেশটির পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবর প্রকাশিত হলে রাত থেকেই রাজধানীর কোথাও কোথাও এই প্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

আর মঙ্গলবার ভোর থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোতেও কয়েক দফায় সব ধরনের পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয় বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একদিনের ব্যবধানেই প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে গেছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি।

গতবছরের সেপ্টেম্বরেও ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে পণ্যটির দাম বাড় বাড়তে প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় উঠে যায়। পরে বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বাজার সহনীয় হতে হতে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়।

সোমবার আবারও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিলে সীমান্তে বাংলাদেশ অভিমুখী পেঁয়াজের ট্রাক আটকে দেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রতি মেট্রিক টন ২৫০ ডলারের এলসির এই পেঁয়াজ এখন বর্ধিত মূল্য ৭৫০ ডলারে এলসি করলেই সেগুলো ছাড়া হবে।

এরপর থেকেই বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি পেঁয়াজের দাম চড়তে শুরু করে।

মঙ্গলবার রাজধানীর শান্তিনগর, মালিবাগ, শাহজাহানপুর, রামপুরা, বাড্ডা বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এর সত্যতাও মিলেছে।

দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় অনেকেই বেশি পেঁয়াজ কিনছেন

বাজারগুলোতে দেখা যায়, যারাই বাজারে বিভিন্ন পণ্য কিনছেন, সঙ্গে পেঁয়াজ নিতে ভুলছেন না। দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় অনেককে অতিরিক্ত পেঁয়াজও কিনতে দেখা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ দাম দ্বিগুণ হওয়ার পরও কোনো কোনো ক্রেতা ১০ কেজি থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনে নিচ্ছেন। এতে করে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

এক লাফে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে খুচরা ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে রপ্তানির বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ‘কারসাজির’ অভিযোগ তুলেছেন।

তবে এভাবে দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের দায়ি এড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জ থেকে যারা দেশি পেঁয়াজ সংগ্রহ করে আড়তে নিয়ে আসেন, তাদের ওপর দোশ চাপিয়েছেন।

মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের বিক্রেতা মো. রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সোমবার তারা প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন।

“আজ সকালে পেঁয়াজ আনতে গিয়ে দেখি পাইকারি দামই দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকা কেজি এবং ভারতীয়টা ৭০ টাকা কেজি হয়েছে। পরে মাত্র ২০ কেজি নিয়ে চলে এসেছি।”

গাজী স্টোর থেকেই ৯০ টাকা দরে সাত কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন স্থানীয় বাসিন্দা হারুন অর রশিদ।

এক সাথে সাত কেজি পেঁয়াজ কেনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের কারণেই পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে বাড়ছে। খবরে দেখলাম সীমান্তে শত শত ট্রাক ভর্তি পেঁয়াজ আটকে দিয়েছে ভারত। তারা পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করেছে। এই কারণে দাম আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।”

গত বছর পেঁয়াজের দাম ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে স্মরণ করে তিনি বলেন, “এবারও দাম বাড়বে বলে মনে করে আগে থেকেই কিছু পেঁয়াজ কিনে রাখলাম।”

দোকানী রুবেল বলেন, একজন ক্রেতা সকালে ৬০ টাকা দরে ১৫ কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ কিনেছেন।

তিনি বলেন, “গতকাল দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। আজ যেহেতু দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে, তাই কাস্টমারের তার প্রয়োজনের অর্ধেক নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে বাজারে দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকত। কিন্তু কাস্টমারদের কেউ কেউ ১০ থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত কিনে ঘরে মজুদ করছে।”

দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় অনেকেই বেশি পেঁয়াজ কিনছেন

শান্তিনগর বাজারের মমতা স্টোরের এক বিক্রেতা বলেন, “কারও দরকার পাঁচ কেজি, তিনি নিচ্ছেন ৫০ কেজি। আজ কেনাই পড়েছে ৮৫ টাকা কেজি। আমাদের কিছু করার নেই। আজকে বেশ কয়েকজন ৩০ কেজি, ৫০ কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনেছেন। দাম আরও বেড়ে যাবে এই ভয়ে।”

এই দোকানের মালিক দেলোয়ার হোসেন জানান, সোমবার তারা দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।

“আজ দেশি পেঁয়াজ ৮৬ এবং ভারতের পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। আজকে দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দর ৮০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকায় কিনতে হয়েছে।”

তিনি জানান, সোমবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দর ছিল ৬০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ছিল ৪২ টাকা।

“আজকে যারা খুব ভোরে পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনেছে তারা একটু কম দামে কিনতে পেরেছেন। আবার যারা একটু বেলা করে গিয়েছেন তাদের আরেকটু বেশি দর দিয়ে কিনতে হয়েছে। এই কারণে খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দামের একটু হেরফের হচ্ছে।”

শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান একটি দোকান থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন।

পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ কিনেছেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের দুইটা বাসা। বেশি পরিমাণ পেঁয়াজের প্রয়োজন পড়ে বলে কিনেছি।

“৮৫ টাকা কেজি কিনেছি। বাজারে কোনো কোনো দোকানে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।”

মালিবাগ বাজারে মঙ্গলবার দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দর

পেঁয়াজের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে শান্তিনগর বাজারের শহিদ জেনারেল স্টোরের মালিক শহিদুল্লাহ তার রসিদ এনে দেখান।

তিনি বলেন, “আজকে দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকা কেজি (পাইকারি) কিনতে হয়েছে, আর বিক্রি করছি ৯০ টাকা কেজি। জানি না কাল পাইকারি বাজারে পাব কিনা।”

রামপুরা বাজারের ব্যবসায়ী মাইদুল ইসলাম মাহিন জানান, সোমবার দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করলেও মঙ্গলবার পাইকারিতেই কেনা পড়েছে দেশিটা ৮৫ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ টাকা।

বাধ্য হয়েই তিনি দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।

লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে রাজধানীর সবচেয়ে পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজেদ দাবি করেন, তাদের দিক থেকে দাম বাড়ানো হয়নি।

“দাম বেড়ে যাওয়াটা…ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে, এটা একটা কারণ। আর যারা গ্রাম-গঞ্জ থেকে আড়তে পেঁয়াজ নিয়ে আসেন তারা ‘বাটপারি‘ করে পেঁয়াজের দামটা বাড়িয়ে দিয়েছে।”

মঙ্গলবার শ্যামবাজারে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৭২ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।