দুর্নীতিকে সমস্যা বলেছেন ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী: জরিপ

দেশের ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2020, 04:14 PM
Updated : 8 August 2020, 04:16 PM

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান শনিবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ‘কোভিড-১৯ অ্যান্ড বিজনেস কনফিডেন্স ফাইন্ডিংস’ শীর্ষক এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জরিপটি পরিচালনা করা হয় বলে জানান তিনি।

সেলিম রায়হান বলেন, দেশের আট বিভাগের মোট ৩০৩টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা এই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫৩টি উৎপাদন খাতের এবং ১৫০টি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান। গত ১৫ থেকে ২৩ জুলাই প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদাধিকারীদের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।

তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আর ৭০ শতাংশ বলেছেন, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলা ব্যবসার জন্য সহায়ক ছিল না।

অন্যদিকে ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছেন, ৭৮ শতাংশ বলেছেন ব্যাংকিং সেবায় সমস্যার কথা, ৬৩ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যার কথা জানিয়েছেন, ৩৮ শতাংশ বলেছেন তাদের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তা যথেষ্ট নয় এবং ২৩ শতাংশ তাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বাণিজ্যের কাঠামোগত সমস্যা (বন্দর ও কাস্টমস), ‘অপ্রতুল’ সরকারি সহযোগিতা, কর ব্যবস্থায় সমস্যা, আর্থিক সেবা প্রাপ্তিতে সমস্যা, ব্যবসা বা সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা, পরিবহনের অবস্থা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বিদ্যুৎ সংযোগ প্রাপ্তিতে সমস্যাকে ব্যবসায় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সেলিম রায়হান বলেন, জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ‘ভালো অবস্থানে’ আছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তাদের প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করার ক্ষমতা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয়, ব্যবসার খরচ এবং বিক্রি ও পণ্য রপ্তানি সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয়।

সেলিম রায়হান বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর এপ্রিল থেকে জুন মাস সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। সব খাতই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তৈরি পোশাক, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, পাইকারি ব্যবসা ও রেস্টুরেন্টের। ঔষধ ও আর্থিক খাতের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল।”

করোনাভাইারাসের ক্ষতি পোষাতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা  নিয়েছে, ৫৫ শতাংশ নেয়নি।

“অন্যদিকে ১১ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানে না। প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা না নেওয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, যারা প্যাকেজের সহায়তা নেননি তাদের ৮৪ শতাংশ বলেছেন তাদের খাতের জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না, ৮২ শতাংশ বলেছেন এই সাহায্য কোনো অনুদান না দেখে তারা তা নেননি।

“অপরদিকে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যারা সহায়তা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বলেছেন, এই সহায়তা খুবই কার্যকরী। ৪০ শতাংশ বলেছেন, সহায়তা তাদের জন্য কার্যকরী ছিল। ৭ শতাংশ এই সহায়তা কার্যকরী বা অকার্যকারী কিছুই মনে করেন না। উত্তরদাতাদের ৪ শতাংশের কাছে এই সহায়তার তেমন কার্যকারিতা নেই এবং ২ শতাংশ কোনো কার্যকারিতা পাননি।”

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “জানি না আমরা কবে এই দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পাব। এখান থেকে মুক্তি পেতে কাজ করতে হবে। এখনই সময় আমাদের মানসিকতা বদলানোর।”

এ বছরের শেষদিকে রপ্তানিতে উন্নতির আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কতটুকু উন্নতি হবে সে বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না। তবে আশা করছি উন্নতি হবে।

“এমনিতেই সাধারণ বছরগুলোতে বিশেষ করে পোশাক খাতে অগাস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত রপ্তানি একটু স্লো থাকে। তাই আগামী মাসগুলো কেমন যাবে জানি না। হয়ত অক্টোবরের পরে গিয়ে আরও কিছু উন্নতি করবে বলে আমি মনে করি।”

জুলাই মাসে রপ্তানি বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “এর আগে কয়েক মাস কিছুটা কম কম যাওয়ার ফলে কিছুটা আগের ফাইলিং রপ্তানি হওয়ার কারণে গত মাসে রপ্তানি বেড়েছে।”

টিপু মুনশি বলেন, “ব্যবসার ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় নিয়ামক হয়ে গেছে কোভিড-১৯। আমরা আশাবাদী এই দুঃসময় আমরা কাটিয়ে উঠব। গেল অর্থবছরে পোশাক খাতের রপ্তানি ২৮ বিলিয়ন নেমে গেলেও এবার তা ৩৪-৩৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।”

মহামারীর মধ্যে চীন থেকে সরে যাওয়া বিদেশি বিনিয়োগ পেতে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও কম্বোডিয়ার তুলনায় কোন কোন জায়গায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে, তা নিয়ে সানেমকে গবেষণা করার অনুরোধ বাণিজ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে জনমিতিক সুবিধার সঙ্গে বিদেশফেরত বাংলাদেশি দক্ষ কর্মী যুক্ত হয়ে কর্মীর ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়, আমাদের কি ট্যাক্স বেশি নাকি অবকাঠামো সমস্যা, নাকি দীর্ঘসূত্রতা, নাকি রেড টেপের সমস্যা?”

সব মিলিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের সমস্যা কোথায়, তা নিয়ে সানেমকে একটি বিস্তারিত গবেষণা করে দেওয়ার অনুরোধ জানান মন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ৪২টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছি। আর আগামী মাসের মধ্যে আরও ১১টি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার কথা রয়েছে। এ মাসেও কয়েকটি দেশের সঙ্গে হতে পারে।”

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, “নীতির আধুনিকায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সেবার মান আরও বাড়াতে হবে।”

আর বিদেশি বিনিয়োগের জন্য কর কাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আলোচকের বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ‘প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কারের’ ওপর জোর দেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।

আলোচনায় অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মনজুর বলেন, “আসলে কোভিড-১৯ এর আগেই আমাদের অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়।

“কী কারণে দেশের অর্থনীতি হোঁচট খাচ্ছে তা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা চালিয়ে তার ভিত্তিতে নীতি কৌশল গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।”