যে সব কারণে এবার চামড়ার দরপতন

গত বারের বিরূপ অভিজ্ঞতায় এবার মহামারীর মধ্যে চাহিদা কম থাকবে ধরে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল ফড়িয়ারা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2020, 07:54 PM
Updated : 3 August 2020, 11:43 AM

এর পাশাপাশি ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়ৎদারদের কয়েকশ কোটি টাকা পাওনা বকেয়া পড়ে থাকা এবং মহামারীকালে বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া চামড়ার দরপতনে ভূমিকা রেখেছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার নির্ধারিত দাম বেঁধে দিলেও বাস্তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর চেয়ে অনেক কম দামেই বিকিকিনি হয়েছে।

শনিবার ঈদের দিন ও রোববার ঈদের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে দুইশ টাকায়ও, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এক বছর আগেও এসব চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় হাতবদল হয়েছে।

এবার যত বড় চামড়াই হোক কোনো কোরবানিদাতা কিংবা সংগ্রহকারী ৬০০ টাকার বেশি দাম পাননি।

এবছর সরকার প্রতিবর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকায় নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ আড়ৎদাররা মাঝারি মানের (২২ ফুট আয়তন) একটি চামড়া ট্যানারিতে বিক্রি করবেন ৭৭০ টাকা থেকে ৮৮০ টাকায়।

গত বছর এসব চামড়া বিক্রি হয়েছিল এক হাজার থেকে ১২০০ টাকায়।

এই বছর একই মানের চামড়াই কোরবানিদাতাদের কাছে থেকে কেনা হয়েছে গড়ে ৩০০/৪০০ টাকা দরে।

দরপতনের সুযোগে দালাল, ফড়িয়া, ব্যাপারী, আড়ৎদার এমনকি এই খাতের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ট্যানারিগুলোর মুনাফা বাড়ার পথ উন্মুক্ত হলেও কেউ দায় নিতে রাজি নয়।

দেশে চামড়ার চাহিদার বেশিরভাগ অংশই পূরণ হয় কোরবানির ঈদে জবাই হওয়া পশু থেকে।

এবার ৭০ লাখ গরু জবাই হবে বলে ধারণা করা হলেও হয়েছে ৫০ লাখের মতো বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। ছাগল ২০ লাখ জবাই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ফড়িয়ারা উধাও

কোরবানির চামড়া তিন হাত হয়ে ট্যানারিতে পৌঁছে। কোরবানিদাতার কাছ থেকে তা কিনে নেন মৌসুমী ব্যবসায়ীর, যাদের ফড়িয়া বলা হয়। তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনেন আড়তদাররা। সেই চামড়া লবণ মাখিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর বিক্রি করা হয় ট্যানারিতে, যেখানে তৈরি হয় চামড়াজাত নানা পণ্য।

গত বছর ফড়িয়ারা যে দরে চামড়া কিনেছিলেন, বিক্রি করতে গিয়ে লাভ তো দূরের কথা কেনা দামও পাননি। তখন অনেকে চামড়া রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলেন কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন।

এবার করোনাভাইরাস মহামারীতে চামড়া সরকারি দরও কমে যাওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া কিনতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ হারান। ফলে অনেক স্থানে কোরবানির চামড়ার ক্রেতাই পাওয়া যাচ্ছিল না।

 

ঈদের দিনের মতো দ্বিতীয় দিন রোববারও দেখা গেছে একই চিত্র।   

মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছে একটি বাড়িতে সকালে কোরবানি শেষ হলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত চামড়ার কোনো ক্রেতা ছিলেন না।

কোরবানির চামড়া কী করবেন- জানতে চাইলে বাড়ির মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, “গত দুইদিনে কেবলমাত্র আপনিই (ক্রেতা ধারণা করে) চামড়া কিনতে আসলেন। যা দাম পাই ছেড়ে দেব।”

গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় পাওয়ার পর তিনি বলেন, “এবার বোঝেন চামড়ার বাজারের অবস্থা। কোনো ক্রেতা চোখে পড়েনি, তাহলে তো দাম পড়বেই। এবার সিন্ডিকেট করে একেবারে ধসায়া দিছে।”

এখন এই চামড়ার কী হবে জানতে চাইলে- শফিকুল বলেন, “কোনো মাদ্রাসা থেকেও কেউ নিতে আসছে না। মিরপুর-১ নম্বরে একটি পরিচিত মাদ্রাসা আছে। বিকালে কেউ একজন সেখানে জমা দিয়ে আসবে।”

সড়কের উপরে পড়ে আছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া। বিক্রি করতে না পারায় এসব চামড়া ফেলে গেছেন তারা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ফড়িয়াদের পাশাপাশি বিভিন্ন মাদ্রাসাও চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। তারা সেগুলো পরে আড়ৎতারদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ফড়িয়ারা উধাও হওয়ায় আড়ৎদারদের নিজেদের লোক পাঠিয়ে এবার বিভিন্ন স্থানে চামড়া কিনতে দেখা গেছে।

চট্টগ্রামের চৌমুহনীর আড়তে মো. আলম নামে একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের বছরগুলোতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ফড়িয়ারা চামড়া নিয়ে এখানে আসত। আর আমরা তাদের কাছ থেকে কিনে নিতাম। এবার সে সংখ্যা কম।

“গতবছর অনেকেই চামড়া কিনে যে ক্ষতিতে পড়েছিলেন তা পুষিয়ে উঠতে পারেননি। যার কারণে এ বছর অনেকই চামড়ার মৌসুমী ব্যবসা করছেন না।”

আড়তদারদের প্রতিনিধি হয়ে চৌমুহনীতে অবস্থান করা একাধিক ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। আর তারা গিয়ে চামড়া নিয়ে আসছেন।

ফড়িয়ারা উধাও হয়ে যাওয়ায় চামড়ার হাতবদলের একটি ধাপ কমে যাওয়ায় আড়ৎদারদের বেশি মুনাফা লাভের সুযোগ তৈরি করেছে।

কোরবানি শেষে শনিবার বিকালে ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় চামড়া সংগ্রহে ব্যস্ত আড়তদারদের প্রতিনিধিরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তবে আড়ৎদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাঠে যত কম দামই থাকুক না কেন, পোস্তার আড়ৎদাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যেই চামড়া কিনছেন।

“প্রতিটি চামড়ার মধ্যে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা চালান দিতে হয়। সেই হিসাব ধরে মাঝারি মানের চামড়াগুলো ৬০০ টাকা করে কেনা হয়েছে। এর থেকে বেশি দিয়ে কিনতে গেলে সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী আড়তের লভ্যাংশ থাকে না।

“এখন কেউ যদি মাঠ পর্যায়ে ৩০০/৪০০ টাকায় চামড়া কেনে, সেটা ভিন্ন হিসাব। দেখা গেছে ৩০০ টাকায় কিনে অনেকে আড়তে ৬০০ টাকা করে বিক্রি করছেন, অর্থাৎ অতি মুনাফা করছেন।”

আড়ৎদারদের পাশাপাশি কিছু ট্যানারিকেও প্রতিনিধি পাঠিয়ে সরাসরি চামড়া কিনেছেন।

রোববার বেলা ৩টার দিকে মিরপুর রোডের ধানমন্ডি এলাকায় দেখা যায়, সাভার-আমিনবাজারের বিভিন্ন ট্যানারির প্রতিনিধিরা ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় ২০ থেকে ৩০ বর্গফুট আয়তনের চামড়া কিনে নিচ্ছেন।

নিজেকে এরিনা ট্যানারির প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে শামসুদ্দোহা নামের একজন ক্রেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোববার সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা করে তারা চামড়া কিনছেন। শনিবার গড়ে ৫০০ টাকা করে চামড়া কেনা হয়েছে।

শামসুদ্দোহা ঈদের দিন আড়াই হাজার চামড়া কিনেছিলেন, পরদিনও হাজারেরও বেশি চামড়া কেনেন।

সদর ট্যানারির প্রতিনিধিও একইভাবে ৪০০ টাকা দরে চামড়া কেনার কথা জানান।

ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া কিনলে বিক্রয় শিকল থেকে ফড়িয়াদের পাশাপাশি আড়ৎদাররাও বাদ পড়ে যান। ফলে ট্যানারির মুনাফা করার সুযোগ বেড়ে যায়।

সদর ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় কম দামে চামড়া কেনার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, “আমরা কোরবানির দিন ও এর পরের দিন ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছি। এটি সরকারি নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি। ঢাকার আশপাশে আমাদের ২০০ লোক কাজ করেছে। প্রথম দিন ১৯ হাজার পিচ চামড়া এবং দ্বিতীয় দিন আরও ১০ হাজার পিচ চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে।”

তাহলে সদর ট্যানারির হয়ে কারা ৪০০ টাকা করে চামড়া সংগ্রহ করল- এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি মাসুদ।

ঈদের পরদিন রোবাবার পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণে ব্যস্ত আড়তের শ্রমিকরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আড়ৎদারদের বকেয়া

ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়ৎদারদের কয়েকশ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

গত বছর আড়ৎদাররা বকেয়া না পাওয়া পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলে দেখা দেয় সঙ্কট। পরে সরকারের মধ্যস্থতায় সেনই জট খোলে।

ট্যানারি মালিকদের কাছে কী পরিমাণ বকেয়া পাওনা রয়েছে আড়তদারদের, তার স্পষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি।

গত বছর হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, এই অঙ্ক অন্তত ৪০০ কোটি টাকা।

এই বছর করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় ট্যানারিগুলো থেকে আড়ৎদারদের পাওনা আদায়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্যানারিগুলো বাকি টাকা কোরবানির ঈদের আগেও পরিশোধ করেনি। টাকা দিলে চামড়ার দাম সঠিক পেত। এ কারণেই চামড়ার দাম কম।”

আড়ৎদাররা বলছেন, বকেয়া টাকা না পাওয়ায় তাদের অনেকে এবার চামড়া কিনতে বেশি টাকা খাটাননি। সেই কারণে দাম গেছে পড়ে।

হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, আড়ৎদাররা বকেয়া পেলে চামড়া কিনতে প্রতিনিধি পাঠাতে পারত। তাহলে বাজারের এই দশা হত না।

তিনি বলেন, “সরকার এইখাতে স্বাল্প সুদে ঋণ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আড়ৎদাররা ঋণ না নিয়ে তাদের বকেয়া টাকা উদ্ধারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে। কারণ এভাবে ঋণ নিয়ে ট্যানারিতে বাকিতে চামড়া বিক্রি করলে সেই ঋণের ফাঁদ থেকে আর ওঠা যাবে না।”

সাভারের ট্যানারিতে মজুদ পুরাতন চামড়া (ফাইল ছবি)

কমেছে চাহিদা

করোনাভাইরাস মহামারীর আগে থেকে বিশ্ব বাজারে চামড়ার দরপতন, দেশের ট্যানারিগুলোতে ফিনিশড লেদার জমে থাকায় চামড়া কেনার চাহিদা এবার ছিল কম।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

সদর ট্যানারির মাসুদ বলেন, “বহু ট্যানারির কাছে গত বছরের চামড়া জমে রয়েছে। ইউরোপে মন্দার কারণে রপ্তানি আদেশ চার ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। ইউরোপে তিন ডলারের পণ্যের দাম নেমে গেছে দেড় ডলারে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে ফিনিশড লেদারের সবচেয়ে বড় বাজার চীনেও ব্যবসা থমকে গেছে।”

হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব বলেন, “২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবর্গফুট কাঁচা চামড়া ১৩০ টাকায়ও বেচাকেনা হয়েছে। এখন সেটা মাত্র ৩০ টাকায় নেমে এসেছে বিশ্ববাজারের দরপতনের কারণে। বিষয়টি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী?”