পুরান ঢাকা ছাড়া জমেনি ঈদবাজার

করোনাভাইরাসের কারণে ঈদুল ফিতরে প্রত্যাশিত বেচা-বিক্রি করতে না পারার আক্ষেপ কোরবানির ঈদে পূরণের আশা করেছিলেন দোকানিরা, সেজন্য ঈদের কয়েক দিন দোকান খোলা রাখার আবেদনও করেছিলেন।

কামাল তালুকদারশামীম আহমেদ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2020, 04:39 PM
Updated : 30 July 2020, 05:48 PM

তবে মহামারীর মধ্যে ঘরমুখী মানুষ মার্কেটে ভিড় না করায় তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। ঈদের একদিন আগে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক, বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স ও ধানমণ্ডির বিপণিবিতানগুলো ঘুরে তেমন ক্রেতা উপস্থিতি দেখা যায়নি। প্রতিবছর এই সময়ে যেখানে ভিড় লেগে যায়, সেখানে এবার ক্রেতার সংখ্যা হাতে গোনা।

শুধু বিপণিবিতান নয়, ঈদের আগে কাঁচাবাজারে মসলাসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দোকানগুলোতেও ব্যবসায়ীদের আশা অনুযায়ী বিক্রি নেই। অনেক দোকানেই ক্রেতা নেই, তাই অলস সময় পার করছেন বিক্রেতারা।

তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে পুরান ঢাকায়, আগে থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের এই এলাকার বিপণিবিতানগুলোতে বেশ ভিড় দেখা গেছে।

নিউ মার্কেট, ধানমণ্ডি, পান্থপথ এলাকায় ক্রেতা না থাকলেও শেষ সময়ে পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, পাটুয়াটুলী, সদরঘাট ও গুলিস্তানসহ ওই এলাকার বিভিন্ন মার্কেটে তুলনামূলক ক্রেতার উপস্থিতি বেশি।

বড় বিপণিবিতানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রেতা-বিক্রেতা চলাচল করলেও ছোট মার্কেটগুলোতে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধিতে অনীহা দেখা যাচ্ছে অনেকের।

রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেট ঈদের আগে ক্রেতায় সরগরম হয়ে ওঠে। এ মার্কেটের প্রবেশপথ থেকে ভেতর পর্যন্ত ক্রেতাদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। তবে এবারের চিত্র পুরোটাই উল্টো, ক্রেতার দেখা নেই।

চৈতী শাড়ি দোকানের বিক্রেতা আশিক রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোরবানির ঈদে রোজার ঈদের তুলনায় বিক্রি কম থাকে। কিন্তু এবার কোনো ক্রেতা নেই বললেই চলে। এ সময় স্বাভাবিক দিনে ১০০ শাড়ি বিক্রি হওয়ার কথা, কিন্তু দিনে ১০টিও বিক্রি নেই।”

গাউছিয়া মার্কেটের গহনা ব্যবসায়ী আরিফুর বলেন, “ঈদের আগে বিক্রি হবে আশা করেছিলাম, কিন্তু ক্রেতার দেখা নেই। আগামীকাল যদি বিক্রি হয় এ আশায় আছি।”

স্বাভাবিক সময়ে গাউছিয়া ও নিউ মার্কেট এলাকায় হকার ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের জন্য চলাফেরা করা যায় না। কিন্তু ফুটপাত ব্যবসায়ীরা থাকলেও এবার তাদের ক্রেতা নেই।

ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট এলাকার ফুটপাতে বাচ্চাদের পোশাক ব্যবসায়ী সুরত আলী বলেন, “এবার কোনো বিক্রি নেই। যাদের আয় কম তারা ফুটপাত থেকে কেনে কিন্তু কেন জানি এবার তাদের দেখা নেই। গত ঈদের মন্দা, এরপর এবার ঈদে মন্দায় পরিবার নিয়ে বিপদে পড়া ছাড়া উপায় নেই।”

যে কোনো ঈদের আগেই নিউ মার্কেট এলাকায় ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। তবে এবার সেই চিত্র নেই। নিউ মার্কেটের ভেতরসহ বাইরে হকারদেরও বিক্রি নেই।

নিউ মার্কেটের প্রবেশ মুখে জীবাণুনাশক স্প্রে টানেল বসানো হয়েছে। সেই টানেলের ভেতর দিয়ে ক্রেতারা যাচ্ছেন ভেতরে। মার্কেটে ক্রেতাদের মুখে মাস্ক দেখা গেলেও দোকান কর্মচারীদের অনেকেরই মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।

নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারেও ভিড় নেই। কাঁচাবাজারের আমরীন স্টোরের কর্মচারী মোসাদ্দেক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ঈদের আগে মসলাসহ নিত্যপণ্য বেশি বিক্রি হয়, তবে এবার ক্রেতা খুবই কম।” 

আমরীনে ক্রেতা থাকলেও অন্যান্য অনেক দোকানেই ক্রেতা উপস্থিতি নেই বললেই চলে। 

কোরবানি উপলক্ষে নিউ মার্কেট এলাকায় ছুরি, কুড়াল, চাপাতি বিক্রি হয় প্রতিবছরই। হার্ডওয়্যার দোকানগুলোর সামনে সাজানো এসব ছুরি-চাপাতি কেনার জন্য কাউকে দেখা যায়নি।

কাঁচাবাজারের সামনে বিক্রেতা আব্বাস শেখ বলেন, “এ সময় মৌসুমী কসাইরা কোরবানির দিনে বসার জন্য এসব ছুরি কেনে। কিন্তু এবার ক্রেতা খুবই কম।”

ক্রেতা নেই এলিফ্যান্ট রোড এলাকার বিপণিবিতানগুলোতেও। এ এলাকায় ঈদের সময়ে প্রচণ্ড যানজট থাকলেও বুধবার দুপুরে পুরো এলাকায়ই ছিল ফাঁকা। এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও চৌরঙ্গীতে পোশাক থেকে শুরু করে জুতার দোকানগুলোতেও ক্রেতা দেখা যায়নি।

বাটা সিগনাল মোড়ে জুতা কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী সাহেদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুব প্রয়োজন, তাই একটা স্যান্ডেল কিনলাম। রোজার ঈদে পরিবারের সবার জন্য কিনেছিলাম, তাই এবার কেনার প্রয়োজন হয়নি।”

রাদু সু স্টোরের বিক্রেতা রনি বলেন, “গত ১০ দিন ধরে তেমন বিক্রি নেই। দরদাম করবে এ রকম ক্রেতাও মিলছে না।”

ধানমণ্ডি এলাকার বিপণিবিতানগুলোতেও ক্রেতা নেই। রাপা প্লাজা বা প্লাজা এ আর-এর মতো শপিং সেন্টারগুলো প্রায় ফাঁকা। প্লাজা এ আর-এর প্রবেশমুখে কর্মরত মার্কেট কর্মচারী শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মার্কেট ফাঁকা, ক্রেতা নেই। দোকানিরা অলস সময় পার করছে।”

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সেও তেমন ক্রেতা নেই। এ বিপণিবিতানের প্রবেশ মুখে বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। এই টানেলের মধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

নিচতলার মোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দোকানগুলোতে কিছু ক্রেতা থাকলেও অন্যান্য ফ্লোরে পোশাক, প্রসাধনী ও জুতার দোকানগুলো প্রায় ক্রেতাশূন্য।

দ্বিতীয় তলার অনিমা ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী আশফাক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্রেতা তো সেই গত দুই মাস ধরেই নেই। ঈদে মনে করেছিলাম ক্রেতা আসবে তাও নেই।”

সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কিশোর কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময় কাটানোর জন্য এ মার্কেটে এসেছি, কেনাকাটার কোনো ইচ্ছা নেই।”

স্বাস্থ্যবিধিতে অনীহা

স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মার্কেটে ঢুকেই তাড়াহুড়া রফিকের; দোকানদারের সঙ্গে কেউ কথা বলছেন কি না বা দোকানে মানুষের ভিড় রয়েছে কি না সেদিকে খেয়াল নেই তার। রফিকের মতো অধিকাংশ ক্রেতাকেই ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে দেখা যায়নি।

পুরান ঢাকার মার্কেটগুলোর মতো একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে রাস্তাঘাটে, টার্মিনালে ও স্টেশনেও।

সরেজমিনে চকবাজার, মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, পাটুয়াটুলী, সদরঘাট ও গুলিস্তানসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে।

আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় একটি দোকানে কথা হয় রফিকের সঙ্গে। স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে এসেছেন কেনাকাট করতে, ছোট্ট একটি জুতা ও কাপড়ের দোকানে ঢুকছেন তিনজন। কিন্তু দোকানে অনেক মানুষ।

এভাবে ঠেলে না ঢুকলে হত না জানতে- প্রশ্ন করলে মৃদু হাসি ছাড়া আর কোনো জবাব দিলেন না রফিক।

গুলিস্তান বায়তুল মোকাররম মার্কেটে বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, অনেক মানুষ, কারও মুখে মাস্ক আছে কারও মুখে নেই। অনেক দোকানদারের মুখেও মাস্ক নেই। কেন নেই জানতে চাইলে একেকজন একেক অজুহাত দেন।

গুলিস্তানে অ্যাপেক্স জুতার দোকানেও দেখা যায় অনেক ভিড়। সেখানে  স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে দেখা যায়নি।

নাবাবপুর হার্ডওয়ারের দোকানদার রাশেদ হাওলাদার মাস্ক ছাড়াই দোকানে বাসে ছিলেন। মাস্ক পরেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নামাজ পড়তে যাব তাই…।”

পাটুয়াটুলী, মিটফোর্ড, বাবুবাজারে ঘুরে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। এসব এলাকায় মাস্ক ছাড়া মানুষই বেশি দেখা গেছে।

মৌলভীবাজারের মসলার দোকানগুলোতে ঈদ সামনে রেখে অনেক ভিড় দেখা যায়, সেখানেও শারীরিক দূরত্ব মানতে দেখা যায়নি।

এর মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে চকবাজারের আনন্দ বেকারীর সামনে লেখা রয়েছে, মাস্ক ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবেশ করবেন না। আর ভেতরে যে কয়জন বিক্রেতা রয়েছে তাদের মুখেও মাস্ক দেখা যায়।

গুলিস্তান থেকে সদরঘাটের ফুটপাতে অংখ্য দোকান রয়েছে- ফল, পোশাকসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ছোট ছোট দোকানিরা। কিন্তু তাদের কারও মুখেই মাস্ক নেই।

এ বিষয়ে বংশাল থানার ওসি শাহীন ফাকিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “সব সময় তাদের বলা হয়, মাইকিং করা হয়। তারপরও মাস্ক পরতে তাদের অনীহা।”

আর কোতয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, “সচেতনতামূলক প্রচার ছাড়াও মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা করা হয়েছে।”

সদরঘাটে মাস্ক ছাড়া ঢুকতে মানা

সদরঘাটের নয়টি গেইট দিয়েই মাস্কবিহীন কোনো যাত্রীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

বৃহ্স্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল নাগাদ অবস্থান করে এই চিত্র দেখা যায়। দুপুরে ৩ নম্বর গেইট দিয়ে দুজন অল্প বয়সী যুবক মাস্ক ছাড়া ঢুকতে গেলে নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের ঢুকতে দেয়নি।

পরে ওই দুই যুবক একজন হকারের কাছ থেকে ১০ টাকা দিয়ে দুটি মাস্ক কিনে সেগুলো পরে ভেতরে প্রবেশ করেন।

বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, “কাউকে মাস্ক ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছি না। আর লঞ্চেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী উঠানো হচ্ছে।”

বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক দীনেশ কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাত্রী সংখ্যা সকালের তুলনায় বিকালে বাড়ছে। বুধবার মোট ৯৩টি লঞ্চ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছেড়ে যায়, বৃহস্পতিবার সেই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।”

বিকাল ৪টা নাগাদ ৪০টি লঞ্চ সদরঘাট ছেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

তবে লঞ্চে যাত্রীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং পন্টুনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল দেখা যায়নি।

অনান্য ঈদের মতোই যাত্রীরা লঞ্চে উঠছেন এবং ডেকে বিছানা করে বসছেন।

তাসরীফ-৪ লঞ্চের ডেকে দেখা যায় অনেক যাত্রী। তবে ওই লঞ্চের একজন কর্মচারী বলেন, “যাত্রী অনেক নয়। ওরা (যাত্রী) এক জায়গায় জড়ো হয়ে রয়েছেন।”