ছোট ঋণ আদায় না হলে ৮০% পর্যন্ত পরিশোধ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

মহামারীকালে ব্যাংকগুলো যাতে বেশি বেশি ছোট ঋণ বিতরণ করে, সেজন্য এই ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব নিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2020, 08:27 PM
Updated : 27 July 2020, 08:27 PM

আর এজন্য ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বা ঋণ নিশ্চয়তা স্কিম’ নামে একটি তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তহবিলের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করবে।

সোমবার এই তহবিলের নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ক্ষুদ্র, কুটির এবং মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছে, তার আওতায় কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্পে (ছোট ঋণ-সিএমএস) বিতরণ করা ঋণ আদায় না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল ঋণের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করবে।

যে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি, তারা এই সুবিধা পাবে না। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য হবে না।

অর্থাৎ সরকারি কোনো বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যতই হোক না কেন, তারা ছোট ঋণ বিতরণ করলে সেই ঋণ আদায় না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল ঋণের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করবে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে সিএমএসএমই খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অনীহা দেখা যাচ্ছে। অথচ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব তুলে ধরে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।

‘কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র (সিএমএস) উদ্যোগ খাতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্ক্রিম’ নামের এই তহবিলের নীতিমালায় বলা হয়েছে, সম্ভাবনাময় সিএমএস খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়ক জামানত গ্রহণের বিষয়টি একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এ খাতে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সামর্থ থাকলেও কেবলমাত্র সহায়ক জামানতের অভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে ঋণ প্রদানে আগ্রহী হয় না।

মহামারীতে এমন ছোট উদ্যোক্তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন (ফাইল ছবি)

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে সিএমএস খাতে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব থেকে উত্তরণ এবং আলোচ্য খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিএমএস উদ্যোগ খাতে জামানতবিহীন ঋণের বিপরীতে ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গত ১৩ এপ্রিল সিএমএসএমই খাতে ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় কেবলমাত্র সিএমএস খাতে চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ঋণের বিপরীতে এ ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রদান করা হবে।

আগ্রহী তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলোচ্য ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধার জন্য নির্ধারিত নীতিমালার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিজিএস ইউনিটের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। চুক্তির আওতায় নির্ধারিত সিএমএস পোর্টফোলিও এর বিপরীতে সিজিএস ইউনিট হতে পোর্টফোলিও গ্যারান্টি প্রদান করা হবে।

উদ্যোক্তা ও ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন প্রক্রিয়া

>> পোর্টফোলিও সীমার আওতায় গ্যারান্টি সুবিধার খাতওয়ারি বিভাজন হবে নিম্নরূপ- ক) কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের আওতায় ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ এবং খ) কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের আওতায় ব্যবসা খাতে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ।

>> ন্যূনতম তিন বছর সিএমএস খাতে ঋণ প্রদানের অভিজ্ঞতা আছে এবং যে বছর আলোচ্য গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় গ্যারান্টি সুবিধার জন্য আবেদন করা হবে, তার পূর্ববর্তী বছরের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ বা তার কম; এ ধরনের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আলোচ্য স্কিমের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ কর্তৃক ঋণ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে গ্যারান্টি সুবিধা প্রাপ্তির জন্য এ বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য হবে না।

>> সিএমএস ঋণের জন্য বিদ্যমান সীমা যাই থাকুক না কেন আলোচ্য স্কিমের আওতায় গ্যারান্টির জন্য ঋণ সুবিধার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা।

>> চলতি ঋণের ক্ষেত্রে স্কিমের আওতায় প্রদেয় গ্যারান্টির মেয়াদ হবে প্রাথমিকভাবে এক বছর। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ সম্পূর্ণ আদায় হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তবে কোনো ঋণ সুবিধা নবায়ন/পুনঃতফসিল করা হলে তা নবায়ন/পুনঃতফসিলের সময়কাল গ্যারান্টির মেয়াদ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নবায়ন/পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সিজিএস ইউনিট হতে গ্যারান্টির মেয়াদ যথাক্রমে বৃদ্ধি করে নিতে হবে।

আবেদন প্রক্রিয়া

>> আগ্রহী ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিজিএস ইউনিটের সাথে ৫ বছরের জন্য ‘অংশগ্রহণ চুক্তি’ করতে হবে। প্রতি বছরের জন্য পৃথক পোর্টফোলিও সীমা নির্ধারিত হবে।

>> ঘোষিত পোর্টফোলিও এর আওতায় গ্রাহকের ঋণ আবেদনসমূহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যাচাই-বাছাইপূর্বক যোগ্য আবেদনসমূহের তালিকা গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্ধারিত ছকে সিজিএস ইউনিটে দাখিল করতে হবে।

>> গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের আবেদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের অনুমোদিত ঋণ নীতিমালার আওতায় গ্রাহকের ঋণ আবেদনসমূহ যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে মর্মে প্রত্যায়নপত্র দাখিল করতে হবে।

>> প্রতি মাসের প্রথম ১০ কার্যদিবসের মধ্যে গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে হবে।

>> আবেদন প্রাপ্তির পর সিজিএস ইউনিট হতে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন করে দ্রুততার সাথে গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হবে। গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের সময় পোর্টফোলিও সীমা যাতে অতিক্রম না করে তা সিজিএস ইউনিট কর্তৃক নিশ্চিত করা হবে।

গ্যারান্টি ফি

সিজিএস ইউনিট ও ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পাদিত দ্বি-পাক্ষিক অংশগ্রহণ চুক্তির আওতায় প্রত্যেক ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাৎসরিক ভিত্তিতে গ্যারান্টি ফি পরিশোধ করতে হবে যা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা-ঋণ গ্রহীতার নিকট হতে আদায় করা যাবে। এ গ্যারান্টি ফি ব্যতীত অন্য কোন ফি/চার্জ এর বিষয়ে ১৩ এপ্রিল জারি করা সার্কুলারের নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।

>> স্কিমে অংশগ্রহণকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি বছরের অবশিষ্ট সময়কাল এবং পরবর্তী প্রতি বছরের জন্য ঘোষিত পোর্টফোলিও সীমার আওতায় গ্যারান্টি রেজ্রিস্ট্রেশনের সময় আবেদন করা ঋণের উপর ১ শতাংশ হারে ১ বছরের জন্য গ্যারান্টি ফি পরিশোধ করতে হবে। গ্যারান্টি চলমান থাকা সাপেক্ষে ১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর পরবর্তী সময় হতে অব্যবহিত পূর্ববর্তী দিনের গ্যারান্টিলব্ধ ঋণ স্থিতির উপর বার্ষিক ভিত্তিতে গ্যারান্টি ফি পরিশোধ করতে হবে।

এক্ষেত্রে যে সকল ব্যাংকের পূর্ববর্তী বছরের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশ বা এর কম তাদের জন্য বার্ষিক দশমিক ৫০ শতাংশ হারে এবং যে সকল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের বেশী তাদের জন্য বার্ষিক দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে গ্যারান্টি ফি প্রদান করতে হবে।

>> প্রতি বছর গ্যারান্টি রেজিস্ট্রেশনের ১৫ দিনের মধ্যে এবং পরবর্তী বছরসমূহে চলমান গ্যারান্টির ক্ষেত্রে বছর সমাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে গ্যারান্টি ফি আগাম পরিশোধ করতে হবে।

সুদের হার

সিএমএসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা তহবিলের নীতিমালার আওতায় এই স্ক্রিমের ঋণের সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণ গ্রহীতাদের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হবে। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সরকার ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার হচ্ছে ৯ দশমিক শূণ্য ৩ শতাংশ। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি।