‘ভুতুড়ে’ বিদ্যুৎ বিলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরু

করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে গ্রাহকের হাতে বিদ্যুতের অতিরিক্ত বিল ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2020, 07:06 PM
Updated : 5 July 2020, 06:55 AM

তদন্তের ভিত্তিতে এরইমধ্যে ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর কয়েকজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং বেশ কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ বিলের গড়মিলের তদন্তও শেষ হয়েছে, সেখানেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের ঘটনায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি-ডিপিডিসির চারজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছেন কোম্পানির পরিচালন বিভাগের অন্যতম পরিচালক এটিএম হারুন উর রশীদ।

তিনি শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুতের অস্বাভাবিক বিল নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ মোট চারজন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৩০ জন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।”

ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের আরেক কোম্পানি ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিটার রিডিং নিয়ে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল।

“এজন্য দুইজন মিটার রিডারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আরও পাঁচজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগের গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে না পারলে তাদেরকেও অব্যাহতি দেওয়া হবে।”

এর বাইরে অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোরও তদন্ত শেষ হয়েছে জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব সুলতান আহমদ শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্তের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক বিল নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের ৩ কোটি ৬৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে দশমিক ০১ শতাংশ গ্রাহক তাদের বিল নিয়ে অভিযোগ করেছেন।

“তবে একজন গ্রাহকের অভিযোগ আসলে সেটাও স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে না। সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে ভুল সংশোধন করতে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে।”

ঢাকায় ডিপিডিসির ১২ লাখ এবং ডেসকোর ১০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এদের মধ্যে পোস্টপেইড গ্রাহক ১৪ লাখ এবং বাকিরা প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। আর বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে রয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ গ্রাহক। অতিরিক্ত বিলের খাড়া পড়েছে এসব গ্রাহকের ওপর।

ডিপিডিসির পরিচালক হারুন উর রশীদ বলেছেন, গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিল নিয়ে যত অভিযোগ ছিল, গণশুনানি করে ‘সবগুলোর সমাধান’ করে দিয়েছেন তারা।

“এখন আর কোনো সমস্যা নেই।”

প্রায় চার হাজার গ্রাহক তাদের বিল নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে অনেক অভিযোগ সঠিক ছিল না। আমরা তাদেরকে সেটা বুঝিয়ে বলেছি। আর যাদের অভিযোগ সঠিক ছিল সেগুলো নানা উপায়ে সমাধান করে দেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রাহকের কাছে আমার বিল কমও গেছে। মে মাসের হিসাবের সময় তা অ্যাডজাস্ট করে দেওয়া হয়েছে।”

সবার সমস্যার সমাধান করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করলেও অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের প্রতিকার না পাওয়ার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

তার বাসভবন ধানমণ্ডির দক্ষিণ হাওয়ার বিদ্যুৎ বিলের চিত্র তুলে ধরে শাওন লিখেছেন, “এবার বোধ হয় খেলাপিদের তালিকায় আমার নাম উঠতে যাচ্ছে!

“গতকাল মে মাসের বিদ্যুৎ বিল পেয়ে আমার এমনটাই অনুভূত হল। আজ ৩০ জুন নাকি এই বিল দেবার শেষ দিন! ৩ জনের ছোট সংসারে আমার সাধারণ সময়ের বিদ্যুৎ বিল (জানুয়ারি: ৪,৬০৪/-, ফেব্রুয়ারি: ৫,৪৫৭/-), আর করোনাকালের (মার্চ: ৯,০৭০/-, এপ্রিল: ২০,৬৯৩/-, মে: ২৯,৮০১/-)।”

এ বিষয়ে ডিপিডিসির কর্মকর্তা হারুন বলেন, শাওনের ওই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন জানান, তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ৯৭২ জন গ্রাহকের বিল দ্বিগুণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের ৮৬ ভাগ অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করে দিয়েছেন।

“যারা বেশি টাকা দিয়েছেন তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আবার বিল বেশি হয়েছে বলে অনেক অভিযোগের সত্যতা ছিল না।”

কারও কাছ থেকে এক টাকাও বাড়তি বিল নেওয়া যাবে না বলে কোম্পানিগুলোকে কড়া বার্তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সচিব সুলতান আহমেদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অস্বাভাবিক বিল কিছুতেই হতে পারে না। একজন গ্রাহক যেটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন তার চেয়ে বেশি বিল কেনই বা দেবেন।

“পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক দুই কোটি ৮৩ লাখ। সেখানে দশমিক শূন্য ১ শতাংশ গ্রাহকের বিল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এগুলো আমরা খুঁজে বের করেছি এবং সেগুলো ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা বলেছি, এটাকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যাবে না। একজন গ্রাহকও যদি এ ধরনের বিল পেয়ে থাকেন সেটাও সংশোধন করা হবে।”

অস্বাভাবিক বিলের পেছনে নানা ব্যাখ্যা

বিদ্যুতের বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে অস্বাভাবিক বিলের পেছনে একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।

তাদের ভাষ্য মতে, মিটার না দেখে অনুমানের ভিত্তিতে বিল করার পাশাপাশি লকডাউনে গ্রাহকরা ঘরে থাকায় ‘বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে’। আবার এই সময়ের মধ্যেই (মার্চে) বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি (৬ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত) কার্যকর করা হয়েছে।

ডিপিডিসির পরিচালক হারুন উর রশীদ বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মার্চ ও এপ্রিলে মিটার না দেখে অনুমানের ভিত্তিতে বিল করা হয়েছে। বিগত মাসের বিদ্যুৎ বিল এবং আগের বছরের একই সময়ের বিল এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তবে পরে মে মাসে যখন মিটার দেখা হয়েছে, তখন ওই দুই মাসের বিল সমন্বয় করতে গিয়েও অনেকের বিল বেশি এসেছে।

আর ডেসকোর প্রকৌশলী মহিউদ্দিন বলেন, “এপ্রিল মাসে বিল কম হয়েছিল। আবার মে মাসের বিল বেশি হয়েছে। কিছু কিছু গ্রাহক স্লাব সুবিধা পায়নি। ৩০০ ইউনিট, ৪০০ ইউনিট ও অন্যান্য ধাপে ধাপে বিলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সুবিধা রয়েছে। এই সুবিধাটুকু বন্ধ রাখা হয়েছিল।

“এপ্রিল মাসে মিটারের রিডিং আনতে পারিনি। মার্চ মাসের ব্যবহৃত ইউনিটের সঙ্গে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে যোগ করে এপ্রিলের বিল করা হয়েছিল। এই হিসাবের ফলে অনেকের এপ্রিল মাসের হিসাবে গরমিল হলেও মে মাসের মিটার রিডিংয়ের ফলে সেটা ঠিক হয়ে গেছে।

“মে মাসে মিটার দেখে বিল করতে গিয়ে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে অনেক গ্রাহকেরই প্রকৃত বিলের চেয়ে কম বিল করা হয়েছে। তখন তার বাদ পড়া বিলটি মে মাসের বিলের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। এসব কারণে মে মাসে অনেকের বিলের পরিমাণ বেড়ে যায়।”

লকডাউনে লোকজন ঘরে অবস্থানের কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার ‘কিছু বেড়েছে’ দাবি করে তিনি বলেন, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মার্চ মাস থেকে বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্যহার।

ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় নিজের বাসার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এপ্রিল মাসের তুলেনায় মে মাসে প্রায় দ্বিগুণ বিল এসেছে। পরে মিটারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় হিসাব ঠিক আছে।”