গ্রামীণফোনের রিট আবেদনের মধ্যে নতুন বিধিনিষেধ

‘সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার’ বা এসএমপি ঘোষণা করে বিটিআরসি যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা চ্যালেঞ্জ করে কোম্পানিটির আদালতে যাওয়ার মধ্যে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2020, 03:44 PM
Updated : 30 June 2020, 05:16 PM

এদিকে নতুন বিধিনিষেধ আরোপের পর গ্রামীণফোন বলেছে, বিটিআরসির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে রিট আবেদনটি প্রত্যাহার করতে চায় তারা।

গ্রাহক সংখ্যায় দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনকে এসএমপি ঘোষণার এক বছরের মাথায় গত ২১ জুন দুটি বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি।

প্রথম নির্দেশনায় গ্রামীণফোনের নতুন সেবা, প্যাকেজ বা অফার চালু করা কঠিন করা হয় এবং দ্বিতীয় নির্দেশনায় নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলানোর ক্ষেত্রে গ্রাহকের গ্রামীণফোন ছাড়ার সুযোগ সহজ করা হয়।

বিটিআরসির ভাষ্য, টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় ‘একক আধিপত্য তৈরির অবস্থা’ যাতে তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে ‘গ্রাহকের স্বার্থে’ এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

অন্যদিকে গ্রামীণফোন বলেছে, বিটিআরসির এসব নতুন নির্দেশনাই বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ এবং গ্রাহক স্বার্থের ‘পরিপন্থি’।

বিটিআরসির ওই বিধিনিষেধ বুধবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। তা স্থগিত চেয়ে গত রোববার হাই কোর্টে রিট আবেদন করে গ্রামীণফোন।

তবে বিটিআরসির সঙ্গে আলোচনা করেই বিষয়টির সুরাহা করতে চাইছে কোম্পানিটি। যে কারণে আপাতত রিট আবেদনটির শুনানি না করার জন্যই বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে।

রিট আবেদনে কী চাওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিটিআরসি থেকে যে দুটো নির্দেশনা এসেছে গ্রামীণফোনের উপরে, সেগুলো চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।”

বিটিআরসি ২০১৮ সালে একটা প্রবিধিমালা জারি করে। এ প্রবিধানমালার মূল কথা হচ্ছে, বাজারে যদি কোনো অপারেটর সংখ্যাগুরু অবস্থানে থাকে অর্থাৎ কোনো অপারেটরের যদি বাজারে ৪০ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার থাকে, তাহলে সেটা ‘সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার’ বা এসএমপি।

আর কোনো মোবাইল অপারেটর এসএমপি হলে তার উপরে বিটিআরসি কিছু বিধি নিষেধ আরোপ পারবে অন্যান্য অপারেটরের তুলনায়।

বাজারে একমাত্র এসএমপি মোবাইল অপারেটর হচ্ছে গ্রামীণফোন। এই কারণে বিটিআরসি গ্রামীণফোনের উপর বিধি-নিষেধ দিয়েছে।

অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর বলেন, “কিন্তু ২০১৮ সালের এসএমপি প্রবিধিমালার ৯ বিধি অনুযায়ী শুধু ৪০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে এসএমপি হওয়ার কারণেই বিটিআরসি আমাকে নির্দেশনা দিতে পারবে না।

“আমার উপরে নির্দেশনা দিতে হলে বিটিআরসির কাছে সে কারণ থাকতে হবে যে, এসএমপি হিসেবে আমার কোনো একটা আচরণ, কাজের কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু বিটিআরসি যখনই বিধিনিষেধ দিচ্ছে, এই ধরনের কারণ সাপেক্ষে দিচ্ছে না। হাই কোর্টের রায়েও আছে, ২০১৮ সালের প্রবিধান না মেনে বিটিআরসি কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে না। এটা বিটিআরসি মানছে না।”

তবে গ্রামীণফোন আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা চাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গ্রামীণফোন আমাকে বললো যে, তারা চেষ্টা করছে বিষয়টি আলাপ-আলোচনা করে নিরসন করার জন্য। যে কারণে না বলা পর্যন্ত এই রিট মামলাটি শুনানির ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না।”

গত ২১ জুন গ্রামীণফোনকে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়, আগাম অনুমোদন ছাড়া গ্রামীণফোন নতুন কোনো সেবা, প্যাকেজ বা অফার দিতে পারবে না। বিদ্যমান সেবা, প্যাকেজ, অফার পরিবর্তন করতে চাইলেও কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে।

আর এখন যেসব সেবা, প্যাকেজ বা অফার চালু আছে, সেগুলো আগামী ৩১ অগাস্টের মধ্যে নতুন করে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।

দ্বিতীয় নির্দেশনায় বলা হয়, নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের বেলায় ‘লকিং পিরিয়ড’ হবে ৬০ দিন, যেখানে অন্য অপারেটরদের ক্ষেত্রে তা ৯০ দিন।

বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী, কেউ গ্রামীণফোন ছাড়তে চাইলে তাকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে না। দুই মাসেই গ্রাহক নতুন অপারেটরে যেতে পারবেন।

গ্রামীণফোনের এ আইনজীবী জানান, গত বছর ১৮ মার্চ চারটি নির্দেশনা দিয়েছিল বিটিআরসি। চ্যালেঞ্জ করার পর হাই কোর্ট সেসব বিধিনিষেধ স্থগিত করার পর বিটিআরসি নিজে থেকেই সেগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

পরবর্তীকালে ৩০ মে আবার চারটি নির্দেশনা আরোপ করে বিটিআরসি। তখনও এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যায় গ্রামীণফোন। হাই কোর্ট সেসব নির্দেশনা স্থগিত করলে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় বিটিআরসি।

কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত হাই কোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ না করে পূর্ণাঙ্গ শুনানি করতে বলে। শুনানি শেষে গত বছর ১৫ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রায় দেয়। রায়ে ৩০ মে আরোপ করা বিটিআরসির নির্দেশনা অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

বিটিআরসি ভবন

নতুন বিধিনিষেধ

গত ২১ জুন দুটি বিধিনিষেধ নিয়ে গ্রামীণফোন রোববার আদালতে রিট আবেদন দায়ের পরপরই আরও একটি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বিটিআরসি।

নতুন বিধিনিষেধে কল টারমিনেটিং অপারেটর হিসেবে গ্রামীণফোনের পাওনা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আগামী ১৬ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।

নতুন এ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্রামীণফোন (এসএমপি অপারেটর) যখন টারমিনেটিং অপারেটর হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে, তখন অরিজিনিটিং অপারেটর (এসএমপি নয়) হতে ১০ পয়সা প্রতি মিনিট এর পরিবর্তে ৭ পয়সা প্রতিমিনিট পাবে বা গ্রহণ করবে।

অবশিষ্ট ৩ পয়সা প্রতি মিনিট নন এসএমপি অপারেটরগুলো অরিজিটিং অপারেটর হিসাবে নিজের কাছে বাংলাদেশে অবস্থিত দেশি ব্যাংকে আলাদা হিসোবে জমা রাখবে, যা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খরচ হবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত ছাড়া এই টাকা খরচ করা যাবে না বা অন্য কোন হিসাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো গ্রাহক টেলিটক হতে গ্রামীণফোনে কল করলে তাহলে টেলিটক অরিজিনেটিং অপারেটর আর জিপি টারমিনেটিং অপারেটর।

সাধারণ নিয়মে অরিজিনেটিং অপারেটর হতে প্রতি মিনিটে ১০ পয়সা করে পেয়ে থাকে টারমিনেটিং অপারেটর।

নতুন এই বিধিনিষেধের কারণে টারমিনেটিং অপারেটর হিসেবে জিপিকে প্রতি মিনিটে ৩ পয়সা করে কম দেবে অন্য (রবি, বাংলালিংক, টেলিটক) অপারেটররা। এই ৩ পয়সা অপারেটররা আলাদা একটি ব্যাংক হিসাবে জমা করবে।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় একক আধিপত্য তৈরির অবস্থা যাতে তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতেই গত রোববার আরও একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতেই এ উদ্যোগ।”

কল টার্মিনেশন থেকে গ্রামীণফোনের আয় কমিয়ে মিনিটে ১০ পয়সার বদলে ৫ পয়সা করার বিষয়ে কমিশন পরে সিদ্ধান্ত নেবে বলে প্রথম নির্দেশনায় বলা হয়েছিল।

এ বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা যৌক্তিভাবেই ৭ পয়সা নির্ধারণ করেছি।”

১ জুলাই থেকে গ্রামীণফোনের প্রথম দুটি বিধিনিষেধ কার্যকর হচ্ছে বলেও জানান বিটিআরসি প্রধান। 

তবে গ্রামীণফোন আদালতে যাওয়ায় তিনি বলেন, “আদালত যা সিদ্ধান্ত দেবে তা আমরা মেনে নেব।”

এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিটিআরসির হিসেবে এপ্রিল শেষে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহক ছিল ১৬ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার। এর মধ্যে সাত কোটি ৪৩ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহক নিয়ে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন।

এছাড়া রবির ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৪৩ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের গ্রাহক ৪৮ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক রয়েছে।

নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে জিপি

মঙ্গলবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্রামীণফোন জানিয়েছে, একটি সেরা এসএমপি কাঠামো প্রতিষ্ঠায় গ্রামীণফোন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করে যাবে। আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া দুটি এসএমপি নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিয়েছে তারা।

তবে এনিয়ে নিজেদের ভিন্নমত তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মোবাইল খাত যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক এবং এখানে গ্রামীণফোন সময়োচিত বিনিয়োগ, নিত্যনতুন উদ্ভাবন এবং বাবসায়িক পরিচালন দক্ষতার মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে।

“গ্রামীণফোন দুটি এমএসপি নির্দেশনার সাথে একমত পোষণ করে না, কারণ এটা গ্রাহক সুবিধা নিশ্চিত করে না এবং বাজারে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণও নেই।”

গ্রামীণফোন আশা প্রকাশ করেছে, বিদ্যমান বোঝাপড়ার যে দূরত্ব রয়েছে, বিটিআরসির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় অংশ হিসেবে গ্রামীণফোন রিট আবেদনটি প্রত্যাহার করতে চায়।