‘ভালো দামে’ আম নিয়ে শঙ্কা কেটেছে চাষি-বিক্রেতাদের

ঝড়বৃষ্টি আর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাগানের আম বিক্রি করে লগ্নির অর্থ তোলা যাবে কিনা তা নিয়ে এবার দুশ্চিন্তায় ছিলেন চাষি থেকে বিক্রেতা সবাই; তবে সেই শঙ্কা সত্যি হয়নি। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2020, 01:59 PM
Updated : 28 June 2020, 02:57 PM

পাইকারি বাজার, খুচরা ফলের দোকান থেকে শুরু করে অলিগলি- সবখানেই মিলছে গ্রীষ্মের সুস্বাদু এই ফল। বিশেষ করে মহামারীর কারণে অনলাইনে বেশ জমিয়ে চলছে আমের বেচাকেনা।

উত্তরাঞ্চলের আম চাষি আর ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপণনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্য বছরের তুলনায় দাম এবার বেশি, তবে বিক্রি ভালো হওয়ায় ক্ষতির শঙ্কা কেটেছে।

দুই হাজারের বেশি ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজের সঙ্গে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলো যুক্ত রয়েছে আম বেচাকেনায়।

গত তিন বছর ধরে রাজশাহীর পুঠিয়ার বিভিন্ন বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আতাবুল ইসলাম নয়ন।

তিনি বলেন, এবার অনলাইনে আম বিক্রি আগের তুলনায় বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অনলাইনে নতুন নতুন ফ্ল্যাটফর্মও গড়ে উঠেছে।

“হিমসাগর, আম্রপালি ও ল্যাংড়া আম বাগান থেকে প্রতি কেজি গড়ে ৭০ টাকায় সংগ্রহ করছি আমরা, আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে আমার দাম পড়ে যাচ্ছে প্রায় ৯০ টাকা। এ বছর আমের ফলন গত দুই বছরের তুলনায় কম ছিল, ভালো বাজার পাওয়ার সেটাও একটা কারণ।”

মহামারীর কারণে এবার সরকারিভাবে ডাক বিভাগ ও রেলওয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আম বাজারে পৌঁছে দেওয়ায় বাগানমালিক কিংবা আম চাষিদের খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। ফলের দোকানগুলোও অন্যবছরের মত আম বিক্রি করতে পারছে।

পুঠিয়ার আম ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার কারণে আম পরিবহন নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। তবে বিশেষ ট্রেন চালু করায় সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। ৫ জুন থেকে ম্যাঙ্গো ট্রেন চালু হয়েছে। এতে কম খরচে আম পরিবহন করা যাচ্ছে।”

প্রতি রাতেই ট্রাক বোঝাই আম এসে নামছে কারওয়ান বাজারে। এখানকার ফল ব্যবসায়ী নূরে আলম জানালেন, সব জাতের আমই বাজারে রয়েছে। ভালো মানের হিমসাগর আম প্রতিকেজি ১২০ টাকা, আম্রপালি ৮০ টাকা, ল্যাংড়া ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

“এবার আমের দামটা গতবারের চেয়ে কেজিতে গড়ে ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা বেশি। তবে খোলা বাজারে আমের ক্রেতা কম। তাই বাধ্য হয়ে কম দামি এবং বেশি দামি দু ধরনের আমই রাখছি।”

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামসুল হক জানান, গত বছর জেলার ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ১০ হাজার ৯৪৭ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে আমের ২০ শতাংশ ক্ষতি হলেও তা পূরণ হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দাম চড়া

মুকুল আসার পর মার্চের শুরুতে কয়েক দফা বৃষ্টি আর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আম ঝরে যাওয়ায় এবার জেলার আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় বিক্রি ভালো হচ্ছে, তবে দুশ্চিন্তা এখনও রয়ে গেছে কারও কারও মধ্যে।

গত সপ্তাহে জেলার অন্যতম আম বাজার শহরের পুরাতন বাজার ঘুরে দেখা গেছে খিরসাপাত আম প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩২০০ থেকে ৪০০০ টাকা, ল্যাংড়া ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। মৌসুমের শুরুতে গোপালভোগ বিক্রি হয় ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা মণ দরে।

এ বাজারের আম ব্যাবসায়ী সুকুমার সাহা ও আব্দুস সামাদ জানান, গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ খিরসাপাত ও ল্যাংড়া আম বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় মণ দরে। আর প্রতি মণ গোপালভোগ আম বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ টাকায়। এবার আম কম উৎপাদন হওয়ায় দাম গত বছরের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজলার আম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাসুদ জানান, তার ১০ বিঘার আম বাগান আছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এবার আম উৎপাদন হয়েছে গতবারের অর্ধেকেরও কম। ফলে বিনিয়োগের অর্ধেক টাকাও উঠে আসবে কিনা তার সন্দেহ আছে।

বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিউসার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ জানান, জেলায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদন হয়। এবার প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আম উৎপাদন কম হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, জেলায় ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। গত বছর দুই লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল। এবার উৎপাদন কম হবে। এ বছর দুই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে তারা আশা করছেন।

গত ৮ জুন থেকে প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় ট্রেনে করে ৭-৮ টন আম যাচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের কেজি প্রতি এক টাকা ৩০ পয়সা করে দিতে হচ্ছে।

এছাড়া ১৩ জুন থেকে প্রধান ডাকঘর তাদের গাড়িতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন পাঁচ টন আম পরিবহন করছে। সেজন্য কোনো চার্জ দিতে হয় না।

চড়া দাম নিয়ে ক্ষতি পোষাচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা

পরিপুষ্ট হওয়ার সময়ই ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মেহেরপুরের বেশিরভাগ বাগানের আম নষ্ট হয়েছিল। সঙ্গে মহামারীর ধাক্কা। আমের চাহিদা ও দাম ভালো হবে না এমন আশঙ্কা ছিল বাগান মালিকদের। তবে এবার আমের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি।

মলিন খন্দকার পাবনার ব্যবসায়ী হলেও স্বাদে-গুণে মেহেরপুরের আম ভালো হয় বলে গত ১০ বছর ধরে সেখানেই লগ্নি করছেন। এবার আম্পানে তার ৩৫৭টি গাছের ৭০ ভাগ আম নষ্ট হয়েছে। এত ক্ষতি আগে কখনও তার হয়নি। তবে তারপরও লোকসান গুণতে হয়নি তাকে।

“ভেবেছিলাম লাভ তো দূরের কথা বাগান মালিকের লিজের টাকা পকেট থেকে দিতে হবে। তবে ৩০ ভাগ আম বিক্রি করে লাভ না হলেও লোকসান হয়নি,” বলেন মলিন খন্দকার।

মেহেরপুর বড় বাজারের আম ব্যবসায়ী কার্তিক চন্দ্র বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে লোকজন কম। ভেবেছিলাম এবার আমে ব্যবসা হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি উল্টো। এবার বাগান মালিকদের কাছ থেকে সবচেয়ে চড়া দামে আম কিনেছি। তারপরও ক্রেতারা কম কেনেনি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা চড়া দামে আম বিক্রি করে ভালো লাভ করেছে।”

গতবার এ জেলায় ১২০০-১৪০০ টাকায় প্রতি মণ হিমসাগর ও ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকায় ল্যাংড়া আম বিক্রি হয়েছে। এবার বিক্রি শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় আম শেষ হয়ে গেছে।

মেহেরপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, “প্রথমে করোনাভাইরাস মেহেরপুরের আমের বাজারে আঘাত হানে। ইউরোপের বাজার বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে লকডাউনের কারণে আভ্যন্তরীণ বাজার নিয়েও শঙ্কিত ছিল সবাই।

“জেলায় সাড়ে ১২ হাজার ছোট-বড় আম বাগান রয়েছে। এই জেলায় ফসলী জমিতেও বাগান করা হয়। কিন্তু আম্পানে জেলার ৭০ ভাগ গাছ থেকে আম পড়ে নষ্ট হয়েছে। এত ক্ষতি ও ঝুঁকির পরও এবার আমের দাম পেয়ে খুশি বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে অনেকটাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন তারা।”

ভালো দাম পাচ্ছেন নওগাঁর চাষিরা

লাভজনক হওয়ায় ধানের জেলা নওগাঁয়ও আমের উৎপাদন বাড়ছে। জেলার ১১ উপজেলায় আম বাগান করা হলেও পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা, বদলগাছি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) রুবিয়া নূর বলেন, গত বছর এই জেলায় জেলায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় সোয়া তিন লাখ টন আম উৎপাদন হয়; যা বিক্রি হয়েছে প্রায় ১১০০ কোটি টাকায়।

“এ বছর জেলায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৫০ হাজার বাগানে আম চাষ হয়েছে। কয়েক দফা ঝড় বৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গতবছরের সমপরিমাণ আম এ বছরও উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।”

পোরশার নিতপুর এলাকার আমচাষী ও বাগান মালিক মাহবুবুল আলম জানান, এক বিঘা জমিতে আম চাষ করে কৃষকের লাভ ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। অথচ এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে পাঁচ হাজার টাকাও লাভ হয়না। এ কারণে এই অঞ্চলের কৃষকরা আম চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। জেলার প্রায় ৫০ হাজার আম বাগানে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

সাপাহারের আমচাষি তছলিম উদ্দিন বলেন, মে থেকে অগাস্ট পর্যন্ত জেলায় আমের বেচাকেনা হয় পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর ও বদলগাছির পাঁচ শতাধিক আড়তে। এসময় আম বিপণনকেন্দ্রিক কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

সাপাহার আম আড়তদার সমিতির সভাপতি কার্তিক চন্দ্র সাহা বলেন, এবার চাষিরা গত বছরের প্রতি মণ আমে অন্তত ৩০০ টাকা বেশি পাচ্ছে।

তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি মণ ল্যাংড়া, হিমসাগর, খিরসাপাত ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা এবং আম্রপালী ২৫০০ থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

[প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফয়সাল আতিক, তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেনরাজশাহী প্রতিনিধি বদরুল হাসান লিটন, মেহেরপুর প্রতিনিধি তুহিন আরন্য, নওগাঁ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি।]