মহামারীতে চাল নিয়ে চালবাজি

মহামারীতেও বোরোর বাম্পার ফলনের মধ্যে ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকল মালিকরা, যার প্রভাবে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম অন্তত দুই থেকে চার টাকা বেড়েছে।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2020, 10:47 AM
Updated : 20 June 2020, 12:57 PM

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে সর্বোচ্চ চার টাকা বা ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে শুক্রবার ৫৪ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হয়।

মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা কেজিতে সর্বোচ্চ তিন টাকা বা ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা এবং মোটা চাল অন্তত দুই টাকা বা ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেড়ে কেজিতে ৩৮ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়।

রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোটামুটি মাসখানেকের ব্যবধানে চালকল মালিকরা ৫০ কেজি চালের বস্তার দাম অন্তত ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

চালের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে মিল মালিকরা বলছেন, সরকার এবার বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের জন্য দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকে ‘ধানের বাজার চড়া’ হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।

তবে তাদের এই যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ প্রতিবছরই সরকার ধান সংগ্রহের জন্য দাম বেঁধে দেয়, এটা নতুন কিছু নয়। আর এবার বোরোর যে দাম ধরা হয়েছে, গতবারও তাই ছিল।

উপরন্তু চালকল মালিকরা চুক্তিমূল্যে বোরো চাল সরবরাহ করছেন না বলে তিন দিন আগে খাদ্যমন্ত্রী তাদের প্রতি যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাতে মিল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর জন্য কারসাজির আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারেন বলে ইঙ্গিত মিলছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার নিজেও পারিবারিকভাবে চাল ব্যবসায় যুক্ত; ফলে এর নাড়িনক্ষত্র তিনি ভালোই জানেন। 

মিরপুর বড়বাগ বাজারের মুদি দোকানি আব্দুর রাজ্জাক জানান, মে মাসের শুরুতে সরু মিনিকেট চাল প্রতিকেজি ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকায়, মাঝারি পাইজাম ৪২ টাকা ও বিআর আটাশ ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। এখন মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫২ টাকা থেকে ৫৪ টাকায়, পাইজাম প্রতিকেজি ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা, বিআর আটাশ প্রতিকেজি ৪৮ টাকা।

টিসিবির হিসাবে, বাজারে সরু (নাজির ও মিনিকেট) চালের দাম একবছরে ৫২-৫৬ টাকা থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। মাঝারি পাইজাম ও লতা এক বছর আগে ছিল প্রতিকেজি ৪৪ থেকে ৫০ টাকা। মূল্য বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। আর মোটা চাল এক বছর আগে ছিল ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ।

চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে মোট ১০ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। গতবারও একই দাম ছিল, তবে সংগ্রহের লক্ষ্য আরও দুই লাখ টন বেশি ছিল। সে হিসেবে বাম্পার ফলন আমলে নিলে ধানের সরবরাহ ঘাটতি বা দাম বাড়ার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। 

ঢাকার মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে চালের পাইকার মহিউদ্দিন হারুন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন ধান উঠার পর প্রায় ১০ দিনের মতো চালের দাম কমেছিল। এক মাস ধরে দাম ‘হু হু করে বাড়ছে’।

“মে মাসের শুরুর দিকে নতুন আটাশ চাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) সাড়ে ১৮০০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকায় বিক্রি করা গেছে। মিনিকেটের দাম নেমেছিল প্রতি বস্তা ২৩০০ টাকায়। এখন আটাশ চাল ২২০০ টাকা ও মিনিকেট চাল ২৫০০ টাকা থেকে ২৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।”

নওগাঁর আরএম রাইস মিলের মালিক জেলা চালকল সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একমাস আগে চালের দাম বেশ কম ছিল। মাঝখানে ধানের দাম বাড়ার পর চালে দাম কিছুটা বেড়েছে।

তিনি বলেন, তারা মিল গেইটে মিনিকেটের বস্তা ২৪৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন, যা আগে ছিল ২৩০০ টাকা।

কুষ্টিয়া জেলা চালকল সমিতির সভাপতি (একাংশ) ও সরনা রাইস এজেন্সির সত্ত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ জানান, এপ্রিল মাসে নতুন ধান উঠার পর মিনিকেট চালের দাম মিল পর্যায়ে প্রতি কেজি ৪৪ টাকায় নেমেছিল। এখন দাম বেড়ে ৪৮ টাকায় উঠে গেছে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি শহীদুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, “এবছর ধানের দাম অনেক বেড়েছে। ধানের দাম বৃদ্ধিতে কৃষক ও কৃষিখাত উপকৃত হবে।

উড়োজাহাজ ব্র্যান্ড চালের উৎপাদক দিনাজপুরের আদর অ্যান্ড মমতা রাইস এজেন্সির পরিচালক শহীদুলের দাবি, ধানের দামের সঙ্গে সমন্বয় করেই চালের দাম বেড়েছে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, “সরকার প্রতিমণ ১০৪০ টাকা ধানের দর বেঁধে দিয়েছে। সেই হিসাবে চালের দাম এখনও কমই আছে বা সঠিক পর্যায়ে আছে।”

তবে চালকল মালিকরা ধানের দাম বেড়েছে বলে দাবি করলেও গত বারের চেয়ে দাম কত বেড়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেননি।

তবে কৃষকরা যে  এখনও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কমে চালকল মালিকদের কাছে ধান সরবরাহ করছেন তা কুষ্টিয়ায় মিরপুরের আমলা গ্রামের কৃষক সুলাইমানের কথায় স্পষ্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবার তিনি ২০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। মিলারদের কাছে মণপ্রতি ধান বিক্রি করেছেন সাড়ে ৮০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকায়।