অ্যাকর্ডের ইতি, পোশাক খাতে আরএসসি পর্বের শুরু

পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ সুরক্ষায় বিদেশি ক্রেতা, উৎপাদনকারী ও ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ প্রয়াসে যাত্রা শুরু করেছে নতুন তদারক সংস্থা আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2020, 05:19 PM
Updated : 1 June 2020, 05:21 PM

এর মধ্য দিয়ে পোশাক শিল্পের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তায় দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের দীর্ঘদিনের সংস্কার কাজ এখন আরসিসির হাতে গেল।

কারখানার কর্মপরিবেশ পরিদর্শন, অবকাঠামো সংস্কার কাজের তদারকি, নিরাপত্তামূলক প্রশিক্ষণ এবং একটি স্বাধীন/স্বতন্ত্র অভিযোগকেন্দ্র পরিচালনা করবে আরএসসি। 

সোমবার আরএসসির প্রথম সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেইফটির বাংলাদেশ অফিসের যাবতীয় কাজ আজ থেকে আরএসসির কাছে ন্যস্ত হল। আরএসসি হচ্ছে একটি স্থায়ী জাতীয় সংগঠন যাতে রয়েছে পোশাক প্রস্তুতকারক, পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও পোশাক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।” 

আরএসসিতে কারখানা মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক ও পরিচালক মিরান আলী, বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি হিসেব আছেন এইচঅ্যান্ডএমের রজার হুবার্ট এবং শ্রমিক প্রতিনিধি হিসাবে আছেন ইন্ড্রাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব চায়না রহমান। 

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এতদিন ধরে অ্যাকর্ড যে ১৬০০ কারখানায় সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল, প্রথম পর্যায়ে সেগুলোতে কর্মপরিবেশ তদারকি করবে আরএসসি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অন্যান্য রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোকে তাদের কার্মপরিধির অন্তর্ভুক্ত করবে। কর্মদক্ষতার উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষার বিভিন্ন দিক এবং শিল্পখাতের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের বিষয়গুলোও নিজেদের কার্যতালিকায় স্থান দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আরএসসির।

২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন, আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। এর বাইরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার উদ্যোগে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণের প্রচলন করা হয়েছে।

এছাড়া মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর উদ্যোগে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন, পোশাকপণ্যের ভ্যালু সংযোজন ও পণ্যের বহুমুখীকরণেও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

অ্যাকর্ডের তদারকি তৎপরতায় যুক্ত ১২০০ এর বেশি কারখানায় ৯০ শতাংশেরও বেশি সংস্কার উদ্যোগ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন হয়েছে। এখন নতুন করে যাত্রা শুরু করা আরএসসি বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে পারবে বলে আশা করছে।

নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, “একটি অভূতপূর্ব জাতীয় উদ্যোগ হিসাবে আরএসসির জন্ম। ব্র্যান্ড ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা বিশ্বব্যাপী প্রমাণ করার চেষ্টা করব যে, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক কেনার জন্য বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ একটি কেন্দ্র।”

শ্রমিক নেতা চায়না রহমান বলেন, “শ্রমিকরা যাতে নবগঠিত আরএসসির ওপর আস্থা রাখতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করব। পোশাক শ্রমিকরা যাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ পায় এবং অন্যান্য নিরাপত্তামূলক বিষয়গুলো যাতে নিশ্চিত হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করবেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা।”

এইচঅ্যান্ডএমের ব্র্যান্ড প্রতিনিধি রজার হুবার্ট বলেন, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়মিতভাবে যাচাই করা হচ্ছে, আরএসসি তা নিশ্চিত করে যাবে।

চলমান কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের পোশাক খাতও একটি কঠিন সময় পার করছে। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে মহামারীর মধ্যেই খুলতে শুরু করেছে কিছু কিছু পোশাক কারখানা। চালু হওয়ার পর কারখানাগুলোতে মহামারী সংক্রান্ত নিরাপত্তা পদক্ষেপ তদারকি করা আরএসসির অন্যতম কাজ হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

অ্যাকর্ড থেকে আরএসসি

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।

তার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি পায়। ২০১৮ সালের মে মাসে অ্যাকর্ডের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

একই সময়ে একই লক্ষ্যে গঠিত আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স নির্দিষ্ট সময়ের পর ফিরে গেলেও কাজ শেষ হয়নি বলে আরও তিন বছর সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় অ্যাকর্ড, যাতে আপত্তি তোলে বাংলাদেশের কারখানাগুলো।

পোশাক কারখানা সংস্কারে অ্যাকর্ড ও আমেরিকান ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল (আরসিসি) গঠন করে সরকার।

মেয়াদ শেষে অ্যাকর্ড তার অবশিষ্ট কাজ কলকারখানা অধিদপ্তরের অধীনস্ত আরসিসির কাছে হস্তান্তরের বিষয়েও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু আরসিসি বাকি কাজ চালিয়ে নিতে পারবে না দাবি করে তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেনি অ্যাকর্ড। এ নিয়ে কারখানা মালিক ও অ্যাকর্ড প্রতিনিধিদের মধ্যে শুরু হয় বিরোধ, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আদালতে গড়ায়।

পরে গত বছরের ৮ মে অ্যাকর্ড ও বিজিএমইএ যৌথভাবে আরও ২৮১ কর্মদিবস কাজ করতে একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করে। গত ১৯ মে এই সমঝোতা চুক্তির ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ উভয়পক্ষকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়।

নতুন এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় ট্রানজিশনাল অ্যাকর্ড। তবে এরপরও অ্যাকর্ড ও কারখানা মালিকদের মধ্যে বিরোধ দূর হয়নি। সংস্কারের নামে অ্যাকর্ড কারখানা মালিকদের হয়রানি করছে এবং রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ ছিল মালিকপক্ষের।

এরপর উভয়পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য আরএসসি গঠিত হয়।