বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান জানিয়েছেন।
আভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল শুরু হবে কি না-জানতে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমরা চেষ্টা করছি। তবে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে পারব না, আগামীকাল ছাড়া। আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। এর অর্থ এই নয় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখনও কনফার্ম কিছু হয়নি।”
বেবিচকের চেয়ারম্যান মো. মফিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুনে আভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দুটোই আমাদের রয়েছে। তবে এজন্য সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
“আগামীকাল আমরা এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।”
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সারা বিশ্বেই যাত্রীবাহী বিমান চলাচল সীমিত হয়ে যায়। এখন কিছু দেশ পুনরায় বিমান চালাতে শুরু করছে।
প্রায় দুই মাস বন্ধ রাখার পর ভারতে সোমবার থেকে আভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৬ মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য সব দেশ থেকে যাত্রীদের আসা বন্ধ করে বাংলাদেশ। পরে অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো বন্ধের মধ্যে তাদের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ফ্লাইট চলাচল শুরুর বিষয়ে সরকারকে তাগাদা দিতে শুরু করেছে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো।
বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা এ টি এম নজরুল ইসলাম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য বেবিচকে আবেদন করবেন তারা।
“আজকে সংগঠনের এক বিশেষ সভায় এই আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
যে অবস্থায় এয়ারলাইন্সগুলো
কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পরই যাত্রীবাহী বিমান সংস্থাগুলোর বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করেছিল ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন।
মার্চের শুরুতেই সংগঠনটি বলেছিল, লকডাউন চলমান থাকলে বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো ১১৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আগের বছরের তুলনায় তাদের ব্যবসা কমবে ১৯ শতাংশ। অবশ্য কোনও কোনও সংস্থা এর চেয়ে বেশি ক্ষতির পূর্বাভাস দিয়েছে।
বিভিন্ন দেশের ক্ষতির প্রভাব কাটাতে এয়ারলাইন্সগুলোকে সরকারি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জার্মান সরকার সে দেশের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স লুফথানসার জন্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা ঘোষণা দিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও দেশে আরও তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স রয়েছে। এগুলো হল- ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স, নভো এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ।
এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই চারটি এয়ারলাইন্সের জনবল রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এছাড়া ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, হজ এজেন্সিসহ ভ্রমণ ব্যবসায় জড়িত চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষের জীবিকাও নির্ভর করছে এ খাতের টিকে থাকার ওপর।
বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো কতটা ক্ষতির সম্মুখীন সে বিষয়ে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও পাক্ষিক মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখন কোন পর্যায়ে আছি তাই তো বুঝতে পারছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিস্থিতি পুরোপুরি শেষ হয় তার আগে সার্বিক অবস্থা বলা যাচ্ছে না।”
এয়ারলাইন্সে কর্মরতদের বেতন অন্যান্য অনেক খাতের তুলনায় বেশি হওয়ায় এ খাতের খরচও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে আরও ব্যয়বহুল বিষয় যেমন- উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ, বন্দরে পার্কিং ও অন্যান্য ফি, ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজের অর্থ পরিশোধ করার মতো বিষয়গুলো।
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়েই এভিয়েশন খাত ‘সবচেয়ে বেশি’ ক্ষতিগ্রস্ত।
“আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়, বরং এখানে সংকট গভীর। এখনও ফ্লাইট অপারেশন শুরু হয়নি। এ পরিস্থিতি কত দিন চলবে সঠিক জানি না।”
বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোতে প্রায় চার হাজার জনবল কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হলে লোকবলের প্রয়োজন হবে। তাই আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আশা করি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের চিন্তা করছে না।”
দেশের চারটি এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন মডেলের ৪৪টি এয়ারক্রাফট রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি নিজস্ব উড়োজাহাজ এবং বাকি ২৪টি ভাড়ায় আনা।
মোটা অংকের ভাড়া পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেককে। একটা এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, তাদের ‘কিছু সংখ্যক’ কর্মী গত এপ্রিল থেকে বেতনবিহীন ছুটি কাটাচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বিমান ইতোমধ্যে সরকারের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকার সহায়তা পেয়েছে।
বিমান সচিব মহিবুল হক গত সপ্তাহে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস নাগাদ বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্স ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা চলছে।
“বিমান এই পরিস্থিতির মধ্যেও বিভিন্ন দেশে চার্টার ফ্লাইট পরিচালনা করে আয়টা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সরকার যে ঋণ দিয়েছে সেখান থেকে বিমান এক হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। এই ঋণ প্রাথমিক সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।”
বিমানের কোনও কর্মীকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে কিছু ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা হয়ত আমরা কমানোর চেষ্টা করব।”
দেশের এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে শুধু ইউএস-বাংলা চীনের গুয়াংজুতে সপ্তাহে একটি করে নিয়মিত ফ্লাইট চালাচ্ছে। এছাড়া লকডাউনের মধ্যে ব্যাংককে ১টি ও ভারতে ১১টি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে বলে ইউএস-বাংলা এয়ালাইন্সের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাশাপাশি কার্গো পরিবহনও করছি। কিন্তু একটি এয়ারলাইন্স পরিচালনার জন্য এটি যথেষ্ট নয়।”
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা নজরুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ৬০ থেকে ৬৫ লাখ যাত্রী বিদেশে যাতায়াত করেন। তার মধ্য বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোতে ৭২ শতাংশ এবং বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোতে ২৮ শতাংশের মতো যাত্রী চলাচল করেন।
এছাড়াও অভ্যন্তরীণ রুটে বছরে আনুমানিক ৩৫ লাখ যাত্রী চলাচলের চাহিদা থাকলেও এখন আনুমানিক ২০ লাখ যাত্রী চলাচল করছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো ১৭টি আন্তর্জাতিক এবং সাতটি অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও ভারত ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই বেশি ফ্লাইট চালানো হয।
আন্তর্জাতিক গন্তব্যে দেশের এয়ারলাইন্সগুলোর বেশিরভাগ যাত্রীই প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এছাড়া হজ, ওমরাহর জন্য বড় সংখ্যক যাত্রী রয়েছেন। করোনাইভাইরাস পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক না হলে সংকট কাটছে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
কাজী ওয়াহিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাবে। একদম স্লো হয়ে যাবে। কবে নতুন রিক্রুটমেন্ট হবে বা আদৌ হবে কি না সেটাও বলা মুশকিল।”
এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা কমে যাবে এবং এটা খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হবে না বলেই মনে করছেন তিনি।
ওয়াহিদুল আলম বলেন, “যদি ধরেও নেই আগামী তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে আসতে থাকে তারপরও কিন্তু মানুষের মনে ভ্রমণের আত্মবিশ্বাস এবং ভ্রমণবান্ধব পরিবেশ ফিরে আসতে বহু সময় লাগবে।”
ব্যবসায়িক ভ্রমণ শুরু হলেও স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দের ভ্রমণ ফিরে আসতে আরও দেড় থেকে দুই বছর লাগতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
ধর্মীয়, চাকুরি, পর্যটন ও অবকাশ যাপন, চিকিৎসার মতো ভ্রমণগুলো এখন একেবারেই হবে না বলে তার ধারণা।
তিনি বলেন, “বিমানের এমডির কথা মতো প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ছয়শ থেকে সাতশ কোটি টাকা তাদের খরচ আছে। এই এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে তাদের কয়দিন চলবে?
“বিমানের আয় একেবারে শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বিমান কতদিন সরকারের সানুগ্রহ নিয়ে টিকতে পারবে? কারণ তাদের এরইমধ্যে ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। আগামীতে সরকার কত টাকা ভর্তুকি দিতে পারবে সেটা সরকারই জানে।”
বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো প্রাণপণে টিকে থাকার চেষ্টা করবে কিন্তু তারও একটা সীমা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের সব বিমান পরিবহন কোম্পানিই সরকারের বিভিন্ন রকমের আর্থিক সহায়তা যেমন- নির্ধারিত প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিমান পরিচালনা সংক্রান্ত অন্যান্য সব নির্ধারিত ফি মওকুফ চাইছে।
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসেসিয়েশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা, যন্ত্রাংশের ট্যাক্স মওকুফ, ল্যান্ডিং, পার্কিং, নেভিগেশন চার্জ মওকুফসহ সরকারের নীতি সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
সংগঠনের মহাসচিব ও নভোএয়ারেরর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, “করোনাভাইরাসের ফলে দেশের এভিয়েশন খাত মহাসংকটের মধ্যে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এভিয়েশন খাতকে যেভাবে সহযোগিতা করছে, আমরাও তেমনটা আশা করছি। এছাড়া টিকে থাকা সম্ভব না।”