কিন্তু বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তৈরি তাদের এসব পোশাক বিক্রির পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে হঠাৎ দেখা দেওয়া নতুন এক মহামারীর তাণ্ডব।
নভেল করোনাভাইরাসের মহাপ্রবল আঘাত শতভাগ থামিয়ে দিয়েছে বৈশাখী পোশাকের বাজার। সুনির্দিষ্ট পার্বণভিত্তিক পণ্যগুলো অবিক্রিত থাকলে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়বে ফ্যাশন হাউজগুলো।
বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। কিন্তু তার আগেই মাসের শুরুতে বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতার আনাগোনা কমতে থাকে।
ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবাসহ জরুরি সেবা ছাড়া কল-কারখানা, অফিস-আদালত, দোকানপাটসহ বাহ্যিক প্রায় সব কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে।
আগামী সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাকের পর্ব কিন্তু এবার কোনো ধরনের বাহ্যিক অনুষ্ঠানিকতা ও জনসমাগম থেকে দূরে থাকতে সরকারিভাবে বারণ করা হয়েছে।
গত ২৫ মার্চ থেকে সারাদেশের সব বিপণি বিতান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। মাসের শুরু থেকেই বিপণি বিতানে ক্রেতার উপস্থিতি কমে যাওয়াও তাদের দোকান বন্ধ রাখার অন্যতম কারণ।
দেশীয় পোশাকের শীর্ষ ১০টি ব্র্যান্ড অঞ্জনস, কে ক্র্যাফট, বাংলার মেলা, রঙ সাদাকালো, বিবিয়ানা, নিপুন, দেশাল, প্রবর্তনা ও সৃষ্টি ব্র্যান্ড সম্মিলিতভাবে ‘দেশিদশ’ নামে বিপণিবিতান খুলে পণ্যের বিপণন করে থাকে।
বাংলা মেলার কর্ণধার একেএম গোলাম মাওলা বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারা বছর যা বিক্রি হয় তার অর্ধেকটা হয় বৈশাখ আর ঈদকে কেন্দ্র করে। এবার বৈশাখে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিক্রির পরিকল্পনা ছিল।
“ঈদেও দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা বেচাকেনা করার মতো পণ্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেইসব প্রস্তুত পণ্য নিয়ে এখন আমরা ঘরে বসে আছি। ঈদ ও বৈশাখকে সামনে রেখে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ভালো প্রস্তুতি নেওয়া ছিল।
“আমরা ডিজাইন করে দিই এবং কাপড় কিনে দেই। সেটা দিয়ে ছোট ছোট প্রডিউসাররা পণ্য প্রস্তুত করে দিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে হাজার হাজার লোক জড়িত এই শিল্পে।”
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ১২টি বিপণন শাখার জন্য বৈশাখ উপলক্ষে প্রায় দেড় কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্য প্রস্তুত করেছে বাংলার মেলা।
যমুন ফিউচার পার্ক শাখার মেলার বিপণন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, আগে মার্চের শুরু থেকেই বেচাকেনা কমে গিয়েছিল। পরে ২৬ মার্চ থেকে সবগুলো বিপণন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
“বৈশাখ কেন্দ্রিক পণ্যগুলো এবার বিক্রি করতে না পারলে আগামী বছরের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে পণ্যের মান ও কালার অবশ্যই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।”
বাংলার মেলায় ১২টি শাখায় শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বৈশাখের নকশা ও পণ্যগুলো একটু ভিন্ন রকম হয়, যেগুলো বৈশাখের পর আর তেমন চলে না।
“পণ্যগুলো মাত্র শোরুমে আশা শুরু করে দিয়েছিল। এর মধ্যেই সবকিছু থমকে গেল। বৈশাখের বেচাকেনা কিছুই হল না। সেই হিসাবে পুরো দুই হাজার কোটি টাকার পণ্যই আটকে গেল।”
দেশীয় ফ্যাশনের অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড অঞ্জনসের কর্নধার শাহিন বলেন, “এখন সারা পৃথিবীর যে অবস্থা তাতে কখন কী স্বাভাবিক হবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটার পর আমরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পরিকল্পনাগুলো হাতে নেব।” বলেন শাহিন।
বৈশাখী পোশাক বিক্রির লক্ষে্য অন্যমেলা, এড্রয়েট, এমক্র্যাফট, নবরূপা, ব্লু আইয়েজ, স্মার্টেক্স,শৈলি্পক, স্টুডিও এমদাদ- আটটি ব্র্যান্ড ‘স্বদেশী’ নামে এক ছাতার নিচে এসেছিল।
স্বদেশীর যমুনা ফিউচার পার্ক শাখার ব্যবস্থাপক রাজু বণিক জানান, প্রতি বৈশাখে তাদের কোটি টাকা বিক্রির টার্গেট থাকে, এর মধ্যে ৮০ ভাগই পূরণ হয়ে যায়। গত বছর ২০ মার্চ থেকেই বৈশাখের কেনাকাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল, এপ্রিল মাসে বিক্রি অনেক বেড়েছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবার পরিকল্পনা মতো সব পণ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিক্রি শূণ্যের ঘরে থাকছে।
অন্যমেলার কর্মকর্তা সানাউল কবির কিরণ বলেন, ফ্যাশন ব্যবসার ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি আর কখনও আসেনি। এর আগে হরতাল অবরোধ হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে দেশ। কিন্তু দিনের বেলায় মার্কেট খুলতে না পারলে রাতে চলেছে। অথবা রাতে বন্ধ ছিল দিনে চলেছে। একটানা এতদিন এভাবে কখনও ব্যবসা বন্ধ থাকেনি।
বৈশাখের মৌসুমে বিপণন বন্ধ থাকায় বিক্রয়কর্মীরাও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
“যারা এখানে বিপণনের কাজ করে তারা বৈশাখ উপলক্ষে অন্য মাসের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি আয় করতে পারেন। তাদেরকে বিপণনের ওপর একটা পার্সেন্টেজ দেওয়া হয়, যা তাদের আয়ের একটা সুযোগ করে দেয়। এবার তারা সেই বাড়তি আয় থেকে একেবারেই বঞ্চিত,” বলেন কিরণ।