করোনাভাইরাস আতঙ্কের সুযোগে চালের বাজার চড়া

মহামারী নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত রাজধানীবাসীর পণ্যের মজুদের ঝোঁকের মধ্যে সুযোগ বুঝে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2020, 11:45 AM
Updated : 20 March 2020, 11:45 AM

মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ১২ টাকা বেড়ে শুক্রবার রাজধানীর কোথাও কোথাও ৬৬ টাকা দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। বেড়েছে ডিম ও মশুর ডালসহ আরও কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।

কয়েক মাস ধরে আকাশচুম্বী পেঁয়াজের দর স্বাভাবিক হওয়ার পথেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দর প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে অন্তত ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

মহামারীর মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দর বৃদ্ধির খাঁড়া নিম্ন আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মধ্যে ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নগরবাসীর কেউ কেউ।

মিরপুরের পীরেরবাগের সুপারশপের পরিচালক ইব্রাহীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন দিন ধরে চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, হ্যান্ডওয়াশসহ আরও কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ক্রেতারা।

“সাধারণত আমরা এক সপ্তাহের জন্য পাইকারি পণ্য সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু এসব পণ্য একদিনেই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় সরবরাহ সংকটে পড়েছি।”

বাড়তি চাহিদা ও সরবরাহ সঙ্কটের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “রশিদ ও মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের বস্তা সপ্তাহের শুরুতে ছিল ২৫০০ টাকা বস্তা, এখন তা হয়ে গেছে ২৮০০ টাকা। খুচরায় এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৩ টাকা। বাসমতি চালের দাম কেজিতে ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে।

“যে মশুর ডাল গত সপ্তাহে প্রতিকেজি ১০২ টাকা করে কিনেছিলাম, সেটা কালকে কিনেছি ১১০ টাকা করে। এখন বাধ্য হয়েই সেই ডাল বিক্রি করছি ১২০ টাকায়। ডিমের ডজন ছিল ৯২ টাকা এখন তা ১১২ টাকা হয়ে গেছে।”

নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার ঢাকার কারওয়ানবাজারে চালের দোকানে ভীড় করেন অনেকে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সামর্থ্যবানরা বাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে মজুদ করছে। কিন্তু এর প্রভাবে বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম বাড়ছে তা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

পীরেরবাগে চালের দোকানি শরীফুল জানান, তার দোকানে সজিব ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের বস্তা ৩০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা চার দিন আগে ছিল ২৭০০ টাকায়। আগের সপ্তাহে এটা বিক্রি হচ্ছিল ২৪০০ টাকায়।

গত দুই দিন মিরপুরের পাইকারি বাজার থেকে তিনি চাল কিনতে পারছেন না দাবি করে তিনি বলেন, “খুচরা ক্রেতারা পাইকারি দোকানে ভিড় করছেন। তাদের কাছে দুই-এক বস্তা করে চড়া দামে বিক্রি করছে পাইকারি দোকানগুলো। তাই আমাদের মোবাইলের অর্ডার নেওয়ার সময় তাদের নেই।”

পাশের দোকানি সুলতান আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে বলেন, রশিদ ও মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের বস্তা বিক্রি করছেন ৩৩০০ টাকায়। কারণ তিনি সকালে ৩১৫০ টাকায় এই চাল কিনে এনেছেন।

“ক্রেতারা দর কষাকষি করছেন না। যিনি কিনতে আসছেন এই দামেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।”

এছাড়া বস্তায় গড়ে ২০০ টাকা বেশি নিয়ে পাইজাম ১৯০০ টাকা, বিআর আটাশ চাল ২১০০ টাকা ও স্বর্ণা চাল ১৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন এই বিক্রেতা।

সুলতানের দাবি যাচাই করতে মিরপুর-১ নম্বরে জননী রাইস এজেন্সি নামের একটি পাইকারি দোকানে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক।

দোকানি মহিউদ্দিন হারুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চালের দাম প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে। এখন তিনি মিনিকেট চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৭৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।

অর্থাৎ চালের পাইকারি দাম নিয়ে খুচরা বিক্রেতা ও পাইকারি বিক্রেতার তথ্যের মধ্যে প্রায় ৪০০ টাকার গরমিল দেখা যাচ্ছে।

দেশের মিনিকেট চালের শীর্ষ সরবরাহকারী চালকল মালিক রশিদ রাইস অ্যাজেন্সির বিপণন বিভাগের পরিচালক তারিক আনাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত সপ্তাহে তারা বস্তাপ্রতি চাল প্রায় ২৫৪৫ টাকায় বিক্রি করেছেন।

“গত সপ্তাহে রশিদ রাইস মিলে প্রচুর অর্ডার পড়েছে। একসঙ্গে প্রায় ২০০ গাড়ি চালের অর্ডার পড়ার পর আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আমাদের কাছে ধানের মজুদ নেই। ওই অর্ডারগুলো সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব হয়নি।”

তিনি বলেন, মৌসুমের শেষ সময়ে মিনিকেট চালের জন্য উপযোগী ধানের দাম বেড়ে গেছে। সর্বশেষ ১২০০ টাকা করে তাদের ধান কিনতে হয়েছিল। এখন ১৩০০-১৪০০ টাকায়ও ধান পাচ্ছেন না বলে তিনি দাবি করে।

“এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মানুষের কেনাকাটা বৃদ্ধি। এসব কারণে বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল হয়েছে। এছাড়া চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে বাজারে চাল ব্যবসার বিভিন্ন স্তরে অনৈতিকতার চর্চা শুরু হয়েছে। এইদিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গত সপ্তাহে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, যা শুক্রবার ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল প্রতি কেজিতে অন্তত ৫ টাকা বেড়ে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে মশুর ডাল অন্তত ৫ টাকা বেড়ে ৬৫ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি এই হিসাবের চেয়ে ঢাকার পাড়া-মহল্লায় পণ্য বাজার বরাবরই বাস্তবে অনেক বেশি থাকে। শুক্রবারও সেই চিত্রের ব্যতিক্রম হয়নি; গত সপ্তাহের ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল পেঁয়াজ, যেটা শুক্রবার ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মওসুমের দেশি রসুন ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাজীপাড়ায় একটি মুদি দোকানে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৭০ টাকা দেখে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন এক ক্রেতা। মাত্র ১০ মিনিট পরই পেঁয়াজ কিনতে এসে তিনি দেখেন, দাম উঠে গেছে প্রতিকেজি ৮০ টাকায়।

এর কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে। প্রতিকেজি ৭৭ টাকা দরে কেনা পেঁয়াজের রশিদ ইতোমধ্যেই দোকানে পৌঁছে গেছে। তাই এখন ৮০ টাকার কমে বিক্রি করা সম্ভব হয়।

শেওড়াপাড়ার মুদি দোকানি আব্দুস সালাম বলেন, দুই দিনের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে প্রতিকেজি ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় এখন বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুনের দাম কেজিতে ৬০ টাকা করে বেড়েছে। আগে যেটা ৮০ টাকায় বিক্রি হতো এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেননি।